ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

২২ স্পটে ব্যারিকেডে ঢাকা অচল ॥ আজ বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে দেশব্যাপী অবরোধ

নির্বাহী বিভাগের প্রতিশ্রুতি পেলে শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়বেন

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:০৫, ১১ জুলাই ২০২৪; আপডেট: ০১:৪৫, ১১ জুলাই ২০২৪

নির্বাহী বিভাগের প্রতিশ্রুতি পেলে শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়বেন

রাজধানীর শাহবাগে সড়ক অবরোধ করে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের মিছিল-স্লোগান

দিনভর ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন শেষে স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে  কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের স্থিতাবস্থার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা বলেছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই। বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শাহবাগসহ রাজধানীর ২২টি স্পটে ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় কোটাবিরোধীরা। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা মহানগর।

দিনভর ছিল তীব্র যানজট। জনজীবনে নেমে আসে চরম ভোগান্তি। বুধবার সন্ধ্যায় কর্মসূচি পালন শেষে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক ঢাবি শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি শুরু হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগ অবরোধ করা হবে।’ এ সময় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পদ থেকে প্রতিশ্রুতি পেলে শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়বেন। পাশাপাশি যৌক্তিক সংস্কার করে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটা রাখারও দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, ‘শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কোটা পেতে পারেন। নাতি-নাতনিরা নন।’
বুধবার সকাল ১০টার পর থেকেই কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। সকাল ১০টার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে লাইব্রেরি চত্বরে গিয়ে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা সেখান থেকে মিছিল করে কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে শাহবাগসহ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। শাহবাগসহ ২২টি পয়েন্টে বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে রাস্তায় অবস্থান করে বিরামহীন স্লোগান দিতে থাকে।

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাজধানীসহ সারাদেশে পালন করে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে।
বেলা সাড়ে ১১টায় কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে এক মাসের স্থিতাবস্থার পর এর  প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই। প্রধান বিচারপতি ছাত্রদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানালেও আন্দোলনকারীরা বলে, আমাদের আন্দোলন আদালতের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে। যতদিন দাবি আদায় না হবে ততদিন আন্দোলন চলবে। আর বৃহত্তর স্বার্থে দেশবাসীকে এ আন্দোলনের কারণে যে সাময়িক কষ্ট হচ্ছে তা মেনে নিতে হবে।

বেলা সাড়ে ১১টায় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রটি বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। 
১০টার দিকে কোটার পক্ষে শাহবাগ এলাকায় অবস্থান নেয় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চসহ বেশ ক’টি সংগঠন। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিল শাহবাগ মোড়ে আসার পর পুলিশের অনুরোধে ওই এলাকা ছেড়ে যান তারা। এ সময় উভয়পক্ষকেই উত্তপ্ত স্লোগান দিতে দেখা যায়। 
এদিন দেখা যায়, হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর আপিল বিভাগের এক মাসের স্থিতাবস্থা দেওয়ার পরও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠে অবস্থান করে কোটাবিরোধীরা। দুপুরে সায়েন্সল্যাব মোড়ে কর্মসূচি চলাকালে শিক্ষার্থীদের পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা কলেজ শাখার সমন্বয়ক নাজমুল হাসান। অন্যান্য পয়েন্ট থেকেও এ ঘোষণা দেওয়া হয়। তারা বলেন, ‘আমরা স্থায়ী সমাধান চাই। কোটা নিয়ে বারবার টালবাহানা দেখতে চাই না।

সব গ্রেডে অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটা ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করতে হবে। আমরা পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে চাই। তবে দাবি মেনে নেওয়া না পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
এদিকে দুপুরে জধানীর কারওয়ানবাজারে রেললাইনের ওপর বসে পড়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তাদের অবরোধের কারণে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদেশের সঙ্গে রেল চলাচল বন্ধ থাকে। একইসঙ্গে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, রিক্সা, ভ্যান, মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয় আন্দোলনকারীরা। 
গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট মোড় ও পল্টন মোড়ও অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গুলিস্তানের নুর হোসেন চত্বর দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ। শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টার পর থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন এই মোড়। গুলিস্তান মোড়ে শিক্ষার্থীরা চারপাশে বৃত্তাকার হয়ে বসে পড়েছেন। শিক্ষার্থীরা দখলে নিয়েছেন পল্টন মোড়ও। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শ্যামপুর, জুরাইন, পুরান ঢাকার লোকজন ঢাকার অন্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এই জিরো পয়েন্ট মোড় ব্যবহার করেন। কিন্তু চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে জিরো পয়েন্টের আশপাশের সড়কে থেমে থাকতে দেখা যায়।

আগারগাঁও মোড়ের চারটি রাস্তা বন্ধ করে দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এতে মিরপুর থেকে গাড়ি আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। শ্যামলী বা বিজয় সরণির দিকেও যাচ্ছে না কোনো গাড়ি। যে গাড়ি যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সময় মিরপুর ও গাবতলীর পথে চলাচলের সড়কটি দিয়েও যান চলাচল ব্যাহত হয়। জরুরি প্রয়োজনে হেঁটে ও গলিপথ ধরে রিকশায় যাতায়াত করছেন পথচারীরা।
আন্দোলনে মহাখালী থেকে বনানী পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ। যানবাহন না চলার কারণে অনেকে হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছেন। অনেকে যানজটে দীর্ঘ সময় গাড়িতে বসে রয়েছেন আশপাশের রাস্তায়। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা। এদিকে একই সময় রামপুরা থেকে শান্তিনগর, কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তায় যানজট ছিল না। রাস্তার পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখা গেছে। প্রতিদিনের মতো আবুল হোটেলের মোড় ও মেরুল বাড্ডা এলাকায় যানবাহনের চাপ বেশি ছিল। এ রাস্তায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চোখে পড়েনি।
জরুরি কাজ ছাড়া সকাল থেকে রাজধানীতে সড়কে বের হননি অনেকেই। এ কারণে বেশিরভাগ সড়ক ছিল অনেকটা ফাঁকা। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা যাতে কোনো বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল সদা সতর্ক। আন্দোলনকারীদের পূর্বনির্ধারিত স্থানে এবং অন্যান্য মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। এভাবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত ছিল পুলিশ সদস্যরা।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ২০১৮ সালের পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দেওয়ার পর সেটির শুনানি হয়েছে। যদি ৫ জুনের রায়টি স্থগিত করে আঠারোর যে পরিপত্র সেটিতে যদি ফিরে যাওয়া হয়, তা হলে আমরা  হাইকোর্টকে স্বাগত জানাব। তবে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আজকে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর চার সপ্তাহের জন্য স্থগিতাবস্থা জারি করেছেন আপিল বিভাগ।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবে বেশ কিছুদিন পর। আমরা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারছি না আজকের এই দিনে শুনানির মাধ্যমে ১৮ সালের পরিপত্র বহাল থাকবে কি না। সেই পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরিপত্রটি আবার অবৈধ ঘোষনা করা হতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমরা শুধু প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণি নয় সরকারি চাকরির সকল গ্রেডের কথা বলছি। এখানে আমরা আমাদের দাবির আংশিক প্রতিফলন দেখতে পাই। 
তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালের যে পরিপত্র সেখানে কোনো কোটা  নেই। সংবিধানে যারা অনগ্রসর জাতি গোষ্ঠী তাদের জন্য সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা প্রতিবন্ধী রয়েছে এখনো তাদের অনগ্রসর জাতি গোষ্ঠীর কাতারে মনে করি। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লোকজন যদি রিট করার পর ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ হয়ে যায়, তাহলে বাকি যে দুটি জনগোষ্ঠী রয়েছে এদের মধ্যে কেউ রিট করবে না বা রিট করে আবার অবৈধ ঘোষণা করবে না এর কোনো নিশ্চয়তা  নেই। 
সেজন্য আমরা বিশ্বাস করি নির্বাহী বিভাগের কাছে থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী আদেশ এবং পরিপত্র এই সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান  দিতে পারবে। আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছি।  সেগুলো হলো- আমরা যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন করছি, যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্বাহী বিভাগ থেকে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাচ্ছি আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলনস্থল ত্যাগ করব না।

আমাদের মূল দাবি ছিল সকল গ্রেডে অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা প্রত্যাহার। যোক্তিক দাবি আদায়ে যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্বাহী বিভাগ থেকে সঠিক তথ্য পাচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।
পূর্বঘোষিত কর্মসসূচি অনুযায়ী বুধবার সকাল ১০টায় শিক্ষার্থীরা ঢাবির হল থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়। সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাহাবাগ অবরোধ করেন। এসময় শিক্ষার্থীদের ‘একাত্তরের পথ ধরো, বাংলা ব্লকেড সফল করো’, ‘ব্লকেড ব্লকেড, বাংলা ব্লকেড’, ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’, ‘সংবিধানের/মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘ লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘ কোটা প্রথা, বাতিল চাই বাতিল চাই’, ‘ কোটা প্রথার বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘ কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। 
শাহবাগে আসার পর আন্দোলনের সমন্বয়কদের নির্দেশনা মোতাবেক বিভক্ত হয়ে শাহবাগের আশেপাশের সড়কগুলো দখল করে অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে, শাহবাগ মোড়, কারওয়ানবাজার মোড়, ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, বাংলামোটর, ফার্মগেট মোড়, শিক্ষা চত্বর, মৎস্য ভবন মোড়, চাঁনখারপুল মোড়, চাঁনখারপুল ফ্লাইওভার এ ওঠার মোড়, বঙ্গবাজার মোড় দখল করে অবরোধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এ ছাড়া, রাজধানীর সায়েন্সল্যাব অবরোধ করে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট মোড় অবরোধ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মহাখালী অংশের সড়ক অবরোধ করে সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা।  সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কসহ সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ময়মনসিংহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রংপুর মডার্ন মোড়সহ রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেওয়ান হাটসহ চট্টগ্রামের  গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজসমূহ। ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।  
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়ক করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা-পটুয়াখালী মহাসড়ক অবরোধ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বরিশাল বিএম কলেজ। 
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। গতকাল সকাল থেকেই অবরোধ করা সড়কগুলোতে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। মাত্র কয়েকটি যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দেয় আন্দোলনকারীরা। তার মধ্যে রয়েছে গণমাধ্যমের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স। তবে, আন্দোলনে গণমাধ্যম কর্মীদেরও শিকার হতে হয়েছে নানা হেনাস্থার। সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র চেক করা হয়েছে মোড়ে মোড়ে। যার কারণে অনেক সাংবাদিক সঠিক সময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারেনি।

এ ছাড়া, রাস্তায় দূরপাল্লার যানবাহন কম থাকায় সঠিক সময়ে পৌছাতে পারেনি অনেক মানুষ। অনেকে যানবাহন না পেয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছেন। স্বল্প যাতায়াতের জন্য অনেককে পায়ে হেটে বা রিক্সা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তবে, এই আন্দোলনকে সুযোগে পরিণত করেছে রিক্সা চালকরা। তারা তাদের রিক্সার ভাড়া দেড় থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন। 
জাহাঙ্গীর নগর ॥ সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেছেন আপিল বিভাগ। 
এই আদেশের ফলে আপাতত বহাল থাকছে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র। তবে আপিল বিভাগের এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে সংসদে আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বুধবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবরোধ কর্মসূচি শেষে এ কথা জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের (জাবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

তারা জানান, সরকারি চাকরির সকল ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রেখে যতদিন পর্যন্ত সংসদে আইন পাস হবে না, ততদিন আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া হবে। বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ প্ল্যাটফর্মের আহ্বানে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন জাবি শিক্ষার্থীরা। এ সময় অচল হয়ে পড়ে মহাসড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে যানজটে আটকে থাকা অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে চলাচলের সুযোগ দেন শিক্ষার্থীরা। 

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ॥ সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের এক দফা দাবিতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে রেলপথ ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় (চবি) ও এর অধিভুক্ত কলেজ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। নগরী দেওয়ানহাট ও টাইগার পাস এলাকায় এ কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময় সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সিডিউল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে রেলওয়ের ট্রেনগুলো। বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনযোগে দেওয়ান হাটে আসেন শিক্ষার্থীরা। ওভার ব্রিজের নিচে অবস্থান করেন তারা। বেলা ১১টা থেকে দেওয়ানহাট এলাকায় তারা রেলপথ অবরোধ করা হয়। 
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ কোটা পুনর্বহাল বাতিল ও কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ফের রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার দুপুর ১২টা থেকে এই অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) প্রায় হাজার খানেক শিক্ষার্থী। এর আগে চলতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীরা তাদের লাগাতার আন্দোলনের অংশ হিসেবে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী চলমান ‘বাংলা ব্লকেড’ এর অংশ হিসেবে বুধবার বেলা ১১টায় কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে সাংস্কৃতিক আসরের আয়োজন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। অবরোধের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর সড়ক ছাড়েন তারা।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা প্রাঙ্গণ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে মহাসড়কে অবস্থান নেয়। অবরোধ চলাকালে বিভিন্ন প্রতিবাদী কবিতা, গান, গীতিনাট্য ও অভিনয়ের মাধ্যমে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। 
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ॥ কোটা পুনর্বহালের রায় বাতিল এবং সংসদে আইন পাস করে কোটা তুলে দেওয়ার দাবিতে খুলনা-ঢাকা ও খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা। বুধবার (১০ জুলাই) বিকেল চারটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদী চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা নগরীর সাচিবুনিয়া বিশ্বরোড মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। 
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ॥ কোটার বিরুদ্ধে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা রংপুরের মডার্ন মোড়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কার ও ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবি আদায়ে পূর্বঘোষিত বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। এ সময় সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুতে হাইকোর্টের  দেওয়া রায়ের ওপর বুধবার আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থা প্রত্যাখ্যান করেন তারা। 
সুষ্ঠু সমাধান না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় মহাসড়কের তিন দিকের শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। অবরোধ কর্মসূচি শুরুর আগে সকাল ১০টা থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যা¤পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। 
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ॥ দেশব্যাপী সকাল সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা চতুর্থ দিনের মতো ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করেন। বুধবার সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা দেওয়ানগঞ্জগামী ‘তিস্তা এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি অবরোধ করেন বাকৃবি শিক্ষার্থীরা। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ট্রেনে থাকা শ’ শ’ যাত্রী।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ॥ কোটা সংস্কারের দাবিতে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। 
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ॥ সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বৈষম্যমূলক কোটা নিরসনের দাবিতে চতুর্থ দিনের মতো সাড়ে চার ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ী অংশ অবরোধ করে রাখেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই অবরোধে অংশ নেন শিক্ষার্থীরা।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ॥ কোটা পদ্ধতির সংস্কার ও ২০১৮ এর পরিপত্র বহালের দাবিতে দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়কের দুই পাশে শতাধিক যানবাহন আটকা পড়ে যায়। 
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ কোটা সংস্কার ও কর্মসংস্থানের দাবিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই কর্মসূচী পালিত হয়।

×