ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

কোটা আন্দোলনকারীদের ঘোষণা ॥ ব্লকেডে অন্তর্ভুক্ত সড়ক-রেলপথ

সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ আজ

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:০৯, ১০ জুলাই ২০২৪

সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ আজ

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন

আবারও ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল এবং ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আজ বুধবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির পালন করবে তারা।  ব্লকেডের আওতায় থাকবে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। তারা বলছেন, এখন আর আমাদের চার দফা দাবি নয়। দাবি একটাই সেটি হল- অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে আইন পাস করতে হবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে সারাদেশে সকাল ১০টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ব্লকেড কর্মসূচি পালিত হবে। এ ব্লকেডের অন্তর্ভুক্ত হবে সড়ক ও রেলপথ। আমাদের সারাদেশের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো অবরোধ করবেন।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ১০ দিন ধরে আমাদের দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলন করে এসেছি। আমাদের দাবি দেশের সকল শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি ও অত্যন্ত যৌক্তিক হওয়ায় তা সকলের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। যদি সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে কমিশন গঠনের মাধ্যমে আমাদের দাবি মেনে নেয়, সেক্ষেত্রেই আমরা রাজপথ ছেড়ে ক্লাসরুমে ফিরে যাব। অন্যথায় আমাদের দাবি আদায়ে আমরা রাজপথ ছেড়ে যাব না।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা কোটার বিরোধিতা করছি না। আমরা ন্যূনতম মাত্রায় কোটার পক্ষে আন্দোলন করছি। কোটা প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য থাকতে পারে। আমরা সব কোটা মিলিয়ে ৫ শতাংশ কোটাকে যুক্তিযুক্ত মনে করি। তিনি আরও বলেন, অনেকেই আমাদের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কি না সেটা নিয়ে আলোচনা করছেন। আমরা পরিষ্কার করে বলছি যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রাখি।
এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল রেখে হাইকোর্টের রায় বাতিলের আপিল শুনানিতে অংশ নিতে চেম্বার আদালতে আবেদন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দুই শিক্ষার্থী। তবে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে চলা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে আন্দোলনকারীরা। মঙ্গলবার দুই শিক্ষার্থীদের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী শাহ মনজুরুল হক এ আবেদন করেন।  আবেদনকারী দুই শিক্ষার্থীরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া ও উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক বডি থেকে কোনো প্রতিনিধি হাইকোর্টে যায়নি। আমাদের এক দফা দাবি দেশের নির্বাহী বিভাগের কাছে সংসদে আইন পাস করে সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে সকল ধরনের বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। এ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাব।
এর আগে চলতি বছরের ৫ জুন ২০১৮ সালের সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা বাতিল সংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এ ঘোষণার পর থেকে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। গত ৬ জুলাই থেকে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি শুরু করে তারা। এ কর্মসূচির আওতায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে তারা। তাদের অবরোধের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল।
ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়। কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন তখনকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে) সব ধরনের কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
২০২১ সালে সেই পরিপত্রের ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে’র অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। এরপর ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওইদিন এই আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন চেম্বার আদালত।
বুয়েট ॥ সরকারি সব গ্রেডের চাকরিতে যৌক্তিক পর্যায়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুরে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে এক মৌন সমাবেশ শিক্ষার্থীরা জানান। সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা কথা বলার চেষ্টা করলে তারা কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে এক লিখিত বিবৃতিতে তারা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে একাত্মতা ও সংহতির কথা বলেন। 
বক্তব্যে বলা হয়, দেশের সর্বস্তরে কোটা সংস্কার বিষয়ক যেসব আন্দোলন হচ্ছে তা অত্যন্ত যৌক্তিক। আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করছি এবং আদালতের প্রতি মেধার মূল্যায়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে অতি দ্রুত রায় প্রদান করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। 
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা দিয়েছিলেন, তখন তা যৌক্তিক এবং জরুরি ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স পেরিয়ে যাওয়ায় তাদের সন্তানদেরও কোটা দেওয়াও যৌক্তিক ছিল। তবে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সচ্ছল জীবন-যাপন করায় তাদের নাতি-নাতনিদের অসচ্ছল জীবন যাপন করতে হয়নি। তাই অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা বিবেচনা করে মেধার স্বার্থে কোটা সংস্কার করা উচিত। 
জাবি ॥ সংবাদদাতা জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে সংস্কারের দাবিতে ফের ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটা থেকে অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়। পরে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে অবরোধ তুলে নেয় তারা। 
এর আগে বেলা তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এসে অবরোধ করে। অবরোধকালে শিক্ষার্থীরা জানায়, তারা কোটা বিরোধী নয়, কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চায়। সংবিধান অনুসারে অনগ্রসর, প্রতিবন্ধী কোটা রেখে সরকারি চাকরির সকল স্তরে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে সংসদে আইন প্রণয়ন করার দাবিও জানায় তারা।
বরিশাল ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। ফলে সারাদেশের সঙ্গে বরিশালের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে মহাসড়ক অবরোধ করে প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর কোটা বাদে বৈষম্যমূলক সব কোটা বাতিলের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। মহাসড়ক অবরোধের কারণে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পরেছে যাত্রীরা। 
রাজশাহী ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের রায় বাতিল এবং কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরাও। মঙ্গলবার দুপুরে কলেজ গেটের সামনে অবস্থান নেন তারা। এ সময় তারা কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ করে রাখেন। প্রায় আধা ঘণ্টা সড়কটি অবরোধ করে রাখে আন্দোলনকারীরা।

×