ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

প্রতি কেজি শুঁটকি এক লাখ টাকা

বৈচিত্র্যময় জীবন সমুদ্রের রাজা ঘোড়া মাছের

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ৯ জুলাই ২০২৪

বৈচিত্র্যময় জীবন সমুদ্রের রাজা ঘোড়া মাছের

সাগরের রাজা ঘোড়া মাছ

ঘোড়া মাছের বাস বঙ্গোপসাগরে। ৫ বছর আগে সেন্টমার্টিন উপকূলে ধরা পড়েছিল বঙ্গোপসাগরের সুন্দরতম এই ‘সী-হর্স’ বা ঘোড়া মাছ। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক সেন্টমার্টিনের উপকূলের নিকটবর্তী ফিশিং জোনে জেলেদের জালে মাত্র একটি ঘোড়া মাছ দেখতে পান।    
ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, ঘোড়া মাছ বঙ্গোপসাগর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেন্টমার্টিনে ৫ বছর পর প্রথমবারের মতো ঘোড়া মাছ দেখা গেল। রাজকীয় ও কাব্যিক জীবন ধারার কারণে বিশ্বে বিখ্যাত এই সামুদ্রিক মাছটি। একসময় সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া উপকূলে ব্যাপকভাবে ধরা পড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে এর তেমন দেখা মিলছিল না।
এ ছাড়া, কয়েকদিন আগে সেন্টমার্টিন উপকূলে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে স্কুবা ডাইভিং করার সময় জিয়াউল হক নামের একজন পেশাদার স্কুবা ডাইভারের ক্যামেরায় প্রবাল প্রাচীরের কাছে একটি ঘোড়া মাছের দৃশ্য ধরা পড়ে বলে জানান স্কুবা ডাইভার শরীফ সরওয়ার। তিনি বলেন, ১২ বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে প্রবাল প্রাচীরের দৃশ্য ধারণের জন্য স্কুবা ডাইভিং করছি। কিন্তু মাত্র দুবার আমার ক্যামেরায় ঘোড়া মাছের দৃশ্য ধরা পড়েছে। 
কক্সবাজারের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী বলেন, ২৭ বছর ধরে ফিশারিঘাটে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। এক সময় এই ঘাটে প্রচুর ঘোড়া মাছ দেখা গেলেও গত ৪-৫ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে না। তিনি জানান, ঘোড়া মাছ কেউ খায় না। এ জন্য জেলেরা এ মাছ ধরে না। তবে, মাঝে-মধ্যে কক্সবাজার উপকূল থেকে ১০-১২ কিলোমিটার নিচে বঙ্গোপসাগরের ১২ বিও (১২ মিটার গভীরতা সম্পন্ন এলাকা) এলাকায় খুঁটা জালে দুয়েকটি ঘোড়া মাছ অন্যান্য মাছের সঙ্গে ধরা পড়ত। কিন্তু ৩-৪ মাস ধরে মাছটি একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। 
একটি সূত্র জানায়, চোরাইপথে এক সময় ঘোড়া মাছের শুঁটকি চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করা হতো। ওষুধি গুণসম্পন্ন এই মাছের প্রতি কেজি শুঁটকির দাম প্রায় এক লাখ টাকা। বাংলাদেশের সংরক্ষিত আইনে ঘোড়া মাছ ধরা, পরিবহন ও বিক্রয় করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই সামুদ্রিক প্রাণীটির পুরুষরা তাদের দেহে নারী সঙ্গীর ডিম ধারণ করে। নিষিক্ত ডিম নিজের দেহে বহন করে এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে বাচ্চা দেয়। 
বিজ্ঞানীরা জানান, গ্রীক শব্দ ‘হিপ্পোস’ মানে ঘোড়া, আর ‘ক্যাম্পোস’ মানে ‘সমুদ্রের রাজা’। এই আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীটির এই পর্যন্ত ৪৭ প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্য ১৪ প্রজাতি গত শতাব্দীতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
সী-হর্স দম্পতিরা দীর্ঘ সময়ের জন্য বা সারাজীবনের জন্য মাত্র একজন সঙ্গীর সঙ্গেই থাকে। প্রতিদিন সকালে ঘোড়া মাছ দম্পতি একে অপরকে অভ্যর্থনা জানাতে আচারানুষ্ঠানিক নৃত্যে লিপ্ত হয়। জটিল, ছন্দময় ও ক্রম মোচড়ের মধ্যদিয়ে তাদের নৃত্য চলে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত। তাদের হাড় শক্ত। এ কারণে অন্যান্য মাছের পক্ষে তাদের হাড় হজম করা বেশ কঠিন। ঘোড়ামাছ সাধারণত লম্বায় ১.৫ সে. মি. থেকে ৩.৫ সে. মি. বা প্রায় দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের দেহের সামনের ভাগ ঘোড়ার মতো। পেছনের দিকে বাঁকানো লেজ আছে। এদের গড় আয়ু ১-৫ বছর। 
প্রাপ্ত বয়স্ক সী-হর্স প্রথমে সঙ্গী বাছাই করে। সাগরের প্রবাল উদ্যানে একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী ঘোড়া মাছ পরস্পরকে প্রাথমিকভাবে পছন্দ হলে উভয় ৭-৮ ঘণ্টা হতে কয়েকদিন পর্যন্ত বিবাহ পূর্ব ঘনিষ্ঠ প্রেমে আবদ্ধ হয়। বিজ্ঞানীরা সীহর্সের এই সময়কালকে নাম দিয়েছেন ‘সী-হর্স কোর্টশিপ’। দীর্ঘ এই প্রেম পর্বে পরস্পর সম্মত হলে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় । এরপর একে অপরকে আর ছেড়ে যায় না।

স্ত্রী মাছ পুরুষ সঙ্গীর পেটের দিকে অবস্থিত বিশেষ থলেতে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়া শেষে দুজনেই প্রথমে শৈবাল বনে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণ পর স্ত্রী অন্যত্র চলে যায়। পুরুষটি নিজদেহে রক্ষিত ডিমের যতœ নিতে এখানে গর্ভকালীন সময় কাটায়। 
তাদের মাথায় মুকুটের মতো যে অংশ থাকে তা প্রজাতি ভেদে আলাদা হয়ে থাকে। বাঁকানো লেজের সাহায্যে এরা প্রবাল প্রাচীরের সামুদ্রিক আগাছা ও শৈবালের সঙ্গে আঁকড়ে থাকে। প্রবাল প্রাচীরের রঙিন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে গায়ের রংও পরিবর্তন করে।

×