ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

চরম ভোগান্তি ॥ আজ কর্মসূচি নেই, বুধবার পূর্ণদিবস ব্লকেড

ফের রাজপথ অবরোধ

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৫৮, ৮ জুলাই ২০২৪; আপডেট: ০১:৪১, ৯ জুলাই ২০২৪

ফের রাজপথ অবরোধ

কোটা বাতিলের দাবিতে সোমবার শিক্ষার্থীরা রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে অবস্থান নেয়

সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বাতিল এবং ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে শাহবাগসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো অবরোধ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের অবরোধের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়ে পরিবহনের যাত্রীরা। সোমবার দুপুর থেকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কগুলো দখল করে তারা।

সোমবার  বিকেল সোয়া ৪টা থেকে টানা প্রায় ৫ ঘণ্টা রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে অবরোধের পর রাত সাড়ে ৮টায় শাহবাগে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি জানান, দ্বিতীয় দিনের বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি শেষে আজ মঙ্গলবার অনলাইন ও অফলাইনে জনসংযোগ ও পরশু পূর্ণদিবস সর্বাত্মক ব্লকেড হবে। আজ সড়ক অবরোধ না থাকলেও, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট চলবে। 
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিকেলে ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করেন আন্দোলনরত ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিকেল ৪টার পর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে ঢাবি শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া, ঢাবি, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, বাংলামোটর মোড়, কাওরান বাজার মোড়, ফার্মগেট মোড়, মৎস্য ভবন মোড়, নীলক্ষেত ও চাঁনখারপুল মোড় দখল করে অবরোধ করেন। এর ফলে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ওই সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে হবে। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
আন্দোলনে অংশ নিয়ে জামিউল হাসান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশ আমাদের অধিকার। সকল শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ সুবিধা করে দিতে হবে। কোটা বৈষম্য কোনো জাতির জন্য কখনই ভালো হতে পারে না। আমরা আমাদের অধিকার চাচ্ছি। করুণা নয়। 
এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে মেট্রোরেলেও চাপ লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে টিকিট কেটেও নির্দিষ্ট সময়ে ভিড়ের কারণে গাড়িতে উঠতে পারেননি। রাব্বি হাসান নামে এক যাত্রী বলেন, আমার বোন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেজন্য উত্তরা যাওয়া লাগে। কিন্তু আন্দোলনের জন্য মেট্রো স্টেশনে আসলাম। কিন্তু ভিড়ের জন্য গাড়িতে উঠতে পারিনি।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে বিকেল সাড়ে ৩টায় শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন। প্রতিটি হল ও বিভাগ থেকে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা গ্রন্থাগারের সামনে সমবেত হন। এরপর গ্রন্থাগারের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হলপাড়া-মুহসীন হল-ভিসি চত্বর-টিএসসি হয়ে শাহবাগে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে গিয়ে তারা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। শিক্ষার্থীদের অবরোধের মুখে সোমবারও শাহবাগসহ আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

এতে বিভিন্ন সড়কে তৈরি হয় তীব্র যানজট। ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে।
শাহবাগ ছাড়াও একই সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দ্বিতীয় দিনের মতো শিক্ষার্থীদের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি চলে। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে থেকে মিন্টো রোড পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে সড়কের দুপাশে কয়েকশ’ গাড়ি আটকা পড়ে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।

এদিন বিকেলে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অবরোধ চলাকালে আন্দোলনকারীরা কোটা প্রথার বিলুপ্ত করতে না পারলে সর্বস্তরে শতভাগ কোটা চালু করে দেওয়ার আহ্বান জানান। তারা বলেন, কোটা মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বড় ধরনের বৈষম্য। আমরা সরকারকে আহ্বান করব, অবিলম্বে কোটা প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করুন, অন্যথায় দেশে শতভাগ কোটা পদ্ধতি চালু করে দিন। যাদের কোটা থাকবে কেবল তারাই চাকরি পাবে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাকরির দরকার নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ঢাকা কলেজের সমন্বয়ক মো. রাকিব হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক জিনিস নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ। সারা বাংলাদেশের সব নাগরিকসহ আমরা তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ। আমরা প্রত্যেকেই সেই আদর্শ ধারণ করি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, তেমনি আমরাও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করছি। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সারাদেশের ছাত্র সমাজ রাজপথে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, আমাদের এই আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন। আমরা চাই সরকার আমাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিক। শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে ফিরে যাবে। আর যদি দাবি মেনে না নেওয়া হয়, তাহলে আমরা ঘরে ফিরব না।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া রফিকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমাদের যদি বাধ্য করা হয় আমরা প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনে যাব। পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা সায়েন্সল্যাবে জড়ো হয়েছি। পরবর্তী কর্মসূচি যা দেওয়া হবে, আমরা সে অনুযায়ী পালন করব।
এর আগে বিকেল তিনটার দিকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ঢাকা কলেজ’ ব্যানারে ঢাকা কলেজ গেট এলাকায় শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। এরপর সিটি কলেজ, ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে যুক্ত হন। অবরোধে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মাথায় জাতীয় পতাকা দেখা গেছে। কেউ কেউ মাথায় ‘কোটামুক্ত দেশ চাই’ লেখা ফিতা বেঁধে রেখেছেন।
বিকেলে সরেজমিনে শাহবাগ মোড়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, মিন্টো রোড, সায়েন্সল্যাব ও বাংলামোটরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ব্যাট-বল হাতে আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে কেউ শর্টপিচ, কেউ শর্টবার ফুটবল আবার কেউ কেউ সড়কে বসে লুডু খেলছেন। তাদের মাথায় বাঁধা কোটা বাতিলের স্লোগান, অনেকের পাশে রাখা স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড।

অবরোধকারী শিক্ষার্থী তাসনিম আহমেদ জানান, সরকারি চাকরিতে যৌক্তিক কোটা সংস্কারের দাবিতে আমাদের এ আন্দোলন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আমরা পুরো ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্ট অবরোধ করেছি। কেউ স্লোগান দিচ্ছেন, কেউ এর মাঝেও পড়াশোনা করছেন। আমরা লুডু খেলছি। অবরোধ দীর্ঘ সময় চলবে, এ জন্য যে যেভাবে পারি সময় কাটাচ্ছি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ॥ বেলা তিনটায় বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে পূর্ব ঘোষণা অনুসারে দুপুর আড়াইটায় বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন তারা। সেখানে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। অবরোধ প্রায় সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত চলে। এ সময় মহাসড়কের দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
অবরোধ কর্মসূচি শেষে একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। দাবিটি হলোÑ ‘সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য কোটাকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে।’ 
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ॥ দুপুর দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড় সংলগ্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ তৃতীয় দিনের মতো অবরোধ করেন। এ সময় ঢাকা থেকে আগত জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে দেন তারা। এর আগে বেলা ১২ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তন সংলগ্ন মুক্তমঞ্চের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয় এবং বাকৃবির কে.আর মার্কেটসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও ভবন ঘুরে জব্বারের মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। এর পর রেলপথ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। 

চট্টগ্রাম ॥ কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামে এবার রেললাইন অবরোধ করেছেন। দুপুর আড়াইটার শাটল ট্রেনে ষোলোশহরে এসে অবস্থান নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা রেললাইন অবরোধ করে কোটা সংস্কারের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। এতে ঐ অঞ্চলের রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। 
গত ছয় দিন ধরে চট্টগ্রামে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। প্রথম দুই দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেন তারা। পরে নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন দানা বাধে। 
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ॥ বেলা সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত খুলনা-ঢাকা মহাসড়কের সাচিবুনিয়া মোড় এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। 
এর আগে শিক্ষার্থীরা দুইদিন জিরো পয়েন্ট মোড় ও দুইদিন শিববাড়ির মোড়ে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ॥ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে আবারও অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে মহাসড়কের কোটবাড়ী এলাকায় অবরোধ করেন তারা।
গাইবান্ধা ॥ বৈষম্যমূলক কোটা বাতিলের দাবিতে দুপুরে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট গাইবান্ধা জেলা শাখার উদ্যোগে জেলা শহরে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে শহরের ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জোটের সমন্বয়ক সেলিমের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন জেলা সভাপতি পরমানন্দ দাস, সাধারণ স¤পাদক রাহেলা সিদ্দিকা, ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সংসদের সাধারণ স¤পাদক মৈত্রেয় হাসান জৈয়িতা প্রমুখ।

×