সিরাজগঞ্জে ভরা বর্ষায় যমুনার সৌন্দর্য দেখতে ভিড় করে মানুষ
প্রমত্ত যমুনা এখন পুর্ণ যৌবনা। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে যমুনার ভরা যৌবন দর্শনে সিরাজগঞ্জের হার্ড পয়েন্টে প্রতিদিনই দর্শনার্থীর ভিড় বাড়ছে। আহ! কত অপরূপ সৌন্দর্য, পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের লাল আভা যমুনার জলে। এই সুন্দর, মনোমুগ্ধকর, নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে ভিড় করছেন সৌন্দর্য পিপাসুরা। রংপুর থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ২০৫ কিলোমিটার পরিধির এই যমুনা নদীর প্রশস্ততা কোথাও ১৪-১৫ কিমি, কোথাও পাঁচ কিমি।
যৌবনের যমুনা প্রলয়ঙ্করী! কখনো স্রোতস্বিনী, কখনো স্থির আবার কখনো একেবারেই শান্ত। এমন ভিন্ন ভিন্ন রূপেই যমুনাকে দেখা যায়। আষাঢ়ে যমুনায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ¯্রােত, আর বড় বড় ঢেউ বইছে। উজান থেকে প্রমত্তা যমুনা বয়ে আনছে পলি মাটি, সেই সঙ্গে খড়কুটো, ছোটবড় নানা জাতের গাছ, গাছের ডাল-পালা। আবার কখনো কখনো ভেসে যেতে দেখা যায় মরা মানুষও। কেউ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে, আবার দুষ্কৃতকারীরা হত্যা করে যমুনায় ফেলে দিচ্ছে। এসব মৃতদেহ যমুনার বুকে ভেসে যায়।
সারাবছরের জমে থাকা যাবতীয় জঞ্জাল যমুনার বিস্তৃত জলরাশি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। নানা জাতের মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে। যমুনাপাড়ের কোথাও কোথাও শিকারিরা বড়শি ফেলে তা শিকার করার জন্যও মেতে উঠেছেন। জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের জন্য তা বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যাচ্ছে।
আষাঢ়ের ঝুম ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার করছেন। এসব নৌকা কখনো উথাল-পাতাল ঢেউয়ের তালে ডুবে যাবার উপক্রম হয়। ডুবতে ডুবতে বেঁচে যান যাত্রীরা। এ ঝুঁকি নিয়ে যমুনার দুর্গম চরের অধিবাসীরা যাতায়াত করেন। এই বর্ষায় নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে দূরগ্রামে শুধু গাছপালা চোখে পড়ে, কদাচিৎ দুই চারটে টিনের ঘর দেখা মেলে চরাঞ্চলের গ্রামে। যমুনার পুর্বপাড়ের চরাঞ্চলের গ্রামের অধিবাসীদের এই বর্ষায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পে এই যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়। ষাটের দশক থেকে ফি বছরই প্রমত্তা যমুনায় ভাঙন দেখা দেয়। বন্যার পানি নদী ছাপিয়ে মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে যায়। নষ্ট হয় জমির ফসল। আবার ভাঙনে নদীপাড়ের আবাদি জমি, বাড়িঘর বিলীন হয় যমুনাগর্ভে। যমুনা পাড়ে যাদের বাড়ি, তারা দেখেছেন নদীর ভাঙন খেলা। নাচুনে নদী যমুনা প্রতিবছরই ভাঙন খেলায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। পাড় ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যায়। বর্ষার আগে কোনোভাবেই বোঝা যায় না এবার কোন পাড় ভাঙবে।
কত সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কী পরিমাণ জমি-জিরাত, বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হবে। যমুনার এই ভাঙনে দিশাহারা মানুষ প্রতিবছরই সহায়সম্বল হারিয়ে নাড়ির বন্ধন, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে দূরে বহু দূরে আশ্রয় নেন। অনেক পরিবারই ১০-১২ বার যমুনার হিংস্র ছোবলে পরাজিত হয়েছে। প্রতিবছর যমুনার এমন হিংস্র আচরণে সিরাজগঞ্জের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত।
তবে যমুনার পশ্চিমপাড়ের দৃশ্যপট ভিন্ন। যৌবনবতী যমুনায় কলকল শব্দে প্রবাহিত জলধারা মানুষকে আলোড়িত করে তুলছে। প্রতিদিন সকাল-বিকেলে সিরাজগঞ্জের হার্ডপয়েন্টে দাঁড়িয়ে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী ও বৃদ্ধ যৌবনবতী যমুনার রূপ অবলোকন করছে। কেউ কেউ পাড়ে নেমে জলকেলিতে মেতে উঠছেন। আবার পাড় ভাঙার দৃশ্যও ফুটে উঠেছে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি, ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে অনেক পরিবার। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের গগনবিদারী আহাজারিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে।
এই যমুনা নদী সিরাজগঞ্জের মানুষের জন্য এক সময় ‘দুঃখ’ ছিল। যেমনটি ছিল চীনের দুঃখ হুয়াংহো নদী। এখন সেই যমুনা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল অবদান রাখছে। যমুনাপাড়েই গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় যমুনাকে শাসন করে বশে আনার ফলে বিধ্বংসী যমুনা সিরাজগঞ্জের সামগ্রিক উন্নয়নে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে, কল্যাণ বয়ে এনেছে। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্যও যমুনারপাড়ে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা’, বইয়ের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে ম্যুরাল, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভসহ নানা স্থাপনা।
এই যমুনাপাড়েই গড়ে উঠেছে মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পপার্ক। শীঘ্রই এ শিল্পপার্ক চালু হচ্ছে। ৬৮ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পসহ প্রায় ৯শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও স্থাপিত হয়েছে যমুনার পশ্চিমপাড়ে। প্রমত্তা যমুনা এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর এই সেতুকে ঘিরে সিরাজগঞ্জে গড়ে উঠছে ইকোনমিক জোন, গোটা উত্তরাঞ্চলজুড়ে সড়ক অবকাঠামোরও উন্নয়ন হয়েছে।
প্রমত্তা যমুনা খনন করে, যমুনাকে শাসন করে, সুচারুভাবে বশে এনে নদীপাড়ে ১৬ বর্গ কিমি জমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এই জমি ব্যবহৃত হচ্ছে বিসিক শিল্পপার্কের কাজে। যমুনার বুকের ওপর সিরাজগঞ্জ সীমানা দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে চার দশমিক আট কিমি দীর্ঘ শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। এ ছাড়াও গ্যাসভিত্তিক শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ বড় বড় অসংখ্য অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। যমুনার পাড়ে শিল্প পার্ক, ইকোনমিক জোন এবং রেলওয়ে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে সিরাজগঞ্জের আর্থ-সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হবে।
যমুনা অপ্রতিরোধ্য নদী নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর মধ্যে এটি একটি। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের প্রধান শাখা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) যমুনা নদীর পরিচিতি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী। যমুনা গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীর সঙ্গে মিশেছে।
এক সময় এই যমুনায় পাল তোলা নৌকা, লঞ্চ, রেলওয়ের স্টিমার, বিদেশী জাহাজ চলাচল করত। এখন সে সব আর দেখা মেলে না। এই বর্ষায়ও নয়। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু নির্মাণের পর সড়ক ও রেলপথ উন্মুক্ত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে স্টিমার, বিদেশী জাহাজ, পাল তোলা বড় বড় নৌকা চলাচল।