ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

জনবল ও যন্ত্রপাতি সংকট

হাসপাতালে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা

প্রবীর বিশ্বাস, খুলনা অফিস

প্রকাশিত: ২১:৩০, ৬ জুলাই ২০২৪; আপডেট: ১০:৫০, ৭ জুলাই ২০২৪

হাসপাতালে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা

খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেঝেতে রোগীদের অবস্থান করতে হয় মাসের পর মাস

এক দুই তিন আবার কখনো চার মাস ধরে অপেক্ষা শুধু অপারেশনের জন্য। এরপরও রোগীরা জানেন না আসলে কবে নাগাদ হবে অপারেশন; আর কবেইবা সুস্থ হয়ে ফিরবেন বাড়ি। দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন না হওয়ায় অনেক রোগীর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থ সংকটসহ নানা অসুবিধায় পড়ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল, যন্ত্রপাতি ও ওটি না থাকায় দিনে দিনে তৈরি হয়েছে এমন জটিলতা।

কত দিনে এই জটিলতার নিরসন হবে তা জানা নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। এমন পরিস্থিতি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের। সাংবাদিক দেখেই হাইমাউ করে কেঁদে উঠলেন রূপসার দিনমজুর জাহাঙ্গীর। গত ১৪ মে খুমেক হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে সাত বছর বয়সী মেয়ে তাহমিদাকে ভর্তি করেন তিনি।

সেই থেকে স্ত্রী খাদিজা বেগম সঙ্গে আরও এক বছর বয়সী এক মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন। মেয়ের নার্ভে সমস্যা। করতে হবে অপারেশন। কিন্তু দেড় মাস পার হলেও অপারেশনের তারিখ জানা নেই তাদের। চেখের পানিতে ফুটে ওঠে অভাব, অনটন আর অসহায়ত্বের কথা। বলেন, হাসপাতালে আসার পর আমার মেয়ের শরীর আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ওই ওয়ার্ডেই দেখা মিলল মাথায় টিউমার নিয়ে ভর্তি হওয়া ফিরোজা বেগমের (৩৮) সঙ্গে। তার অপারেশন তিন মাসের আগে হবে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। বাইরে ক্লিনিকে দ্রুত সময়ে হবে অপারেশন, প্রয়োজন দেড় লাখ টাকা। কিন্তু গৃহকর্মী ওই নারীর সামর্থ্য না থাকায় নিরুপায় হয়েই থাকতে হচ্ছে হাসপাতালে। আর সীমা খাতুন (৩০) মেরুদ-ের অপারেশনের জন্যে অপেক্ষা করছেন প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে। এ ছাড়া অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে গাড়ি দুর্ঘটনায় দুই মাস আগে থেকে আছেন প্রকাশ চন্দ্র বিশ্বাস (৪৫)।

ইউরোলজি ওয়ার্ডে আড়াই মাস ধরে একই বিছানায় আব্দুর রাজ্জাক (৮৫)। এমন অবস্থা হাসপাতালের ইউরোলজি, নিউরোলজি, অর্থোপেডিক্স, বার্ন, কিডনিসহ প্রায় সকল বিভাগের। যেখানে কয়েকশ’ রোগী মাসের পর মাস অপেক্ষা করছেন অপারেশনের জন্য। সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালে নিয়মিত তিনটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) থাকলেও একটিতে লাইট, এসি, টেবিলসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে সেটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

আর জরুরি রোগীদের জন্য আরও তিনটি ওটির মধ্যে একটি ব্যবহার হচ্ছে স্টোর রুম হিসেবে। আরও একটি কক্ষের সামনে ওটি লেখা থাকলেও সেটি কোনোদিনই ব্যবহার হয়নি। 
খুমেক হাসপাতালের আরএমও ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, ছয়টি ওটির মধ্যে চারটি চলমান রয়েছে। ফলে সপ্তাহে এক বিভাগকে এক বেলার জন্য সিডিউল দেওয়া হয়। যেখানে দুইটির বেশি অপারেশন সাধারণত করা যায় না। সেদিন আবার কোনো কারণে ছুটি থাকলে ওই রোগীকে পরের সপ্তাহের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এর ফলে শয্যা আটকা থাকায় নতুন রোগীদের দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে বারান্দা, লবি কিংবা হাসপাতালের কোনো ফাঁকা স্থানে। তিনি আরও বলেন, ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও জনবল কাঠামো দিয়ে প্রতিদিন দেড় হাজারের ওপরে রোগীর সেবা দেওয়া হচ্ছে।

অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের ইনচার্জ ডা. দিলীপ কুমার কুন্ডু বলেন, শুধু অবকাঠামো আর যন্ত্রপাতি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এই বিভাগে ৪৫ জন জনবল থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ১০ জন। এর মধ্যে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট পদে ১৯ জনের বিপরীতে মাত্র দুইজন কাজ করছেন। 
বাগেরহাটে ১৬ মাসে ৩০ বার অচল লিফট
স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট থেকে জানান, প্রায় ১৭ লাখ লোক অধ্যুষিত বাগেরহাট জেলার প্রধান স্বাস্থ্যকেন্দ্র ‘বাগেরহাট ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতাল’। ৭ তলা বিশিষ্ট এ হাসপাতাল ভবনের রোগীদের ওঠা-নামার জন্য দুইটি লিফট আছে। যা চালু হবার পর থেকে গত ১৬ মাসে কমপক্ষে ৩০ বার অচল হয়েছে। কখনো কখনো দুইটি লিফট একইসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রতি মাসেই অন্তত দুইবার নষ্ট হয়। আর লিফট বন্ধ থাকায় অসুস্থ মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। স্বজনদের বাধ্য হতে হয় রোগীদের কাঁধে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠাতে ও নামাতে। আর যাদের পর্যাপ্ত স্বজন থাকে না, তাদের পোহাতে হয় অশেষ ভোগান্তি। 
কয়েকদিন আগেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে একত্রে বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালটির লিফট দুইটি। এ সময় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা তাদের রোগীদের কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন। এভাবে উঠতে রোগী ও তাদের স্বজনদের খুব বেগ পেতে হচ্ছে। কখনো আবার ট্রলি না পাওয়ার কারণে স্বজনরা তার রোগীকে পাঁজাকোলা কিংবা ঘাড়ে করে উঠাচ্ছেন। লিফট বন্ধ থাকলে সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ডেলিভারি ও মুমূর্ষু রোগীদের। স্ট্রেচার কাঁধে করে সিঁড়ি বেয়ে তাদের ওয়ার্ডে বা কেবিনে নিতে হয়। এতে সীমাহীন কষ্ট হয় অনেক রোগীর। 
বাগেরহাট জেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সভাপতি অ্যাড. শাহ্ আলম টুকু এবং সদর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন বলেন, ‘প্রতি মাসে এভাবে লিফট অচল হলে রোগী ও তাদের স্বজনদের চরম ভোগান্তি হয়। লিফট দুটির যান্ত্রিক ত্রুটি জরুরি ভিত্তিতে নিরসন করা প্রয়োজন।’ লিফট বন্ধ থাকলে রোগীদের ভোগান্তি কমাতে বিকল্প লিফটের পাশাপাশি র‌্যাম্পের ব্যবস্থা করার দাবি জানান তারা। 
লিফট নিয়ে ভোগান্তির কথা স্বীকার করে বাগেরহাটের ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার সমদ্দার বলেন, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চালু হওয়া ৭ তলা ভবনের দুইটি লিফট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে গত ১৬ মাসে অন্তত ৩০ বার অচল হয়েছে। এতে আমাদেরও ভোগান্তি হয়। তবে লিফট দ্রুত মেরামত করতে গণপূর্ত বিভাগকে পত্র দেওয়া হয়েছে। আশাকরি শীঘ্র সমস্যার সমাধান হবে।
সাটুরিয়ায় সেবা বঞ্চিত
নিজস্ব সংবাদদাতা সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ থেকে জানান, সাটুরিয়া উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালটি জনবল সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। হাসপাতালে কোটি টাকা মূল্যমানের চিকিৎসা সরঞ্জামাদি রয়েছে। সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে কয়েকটি নতুন ভবন। সাটুরিয়া উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আ খ ম  নুরুল হক অভিযোগ করে বলেন, তিনি বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ডাক্তার দেখাতে হাসপাতালে আসেন। কিন্তু এসে দেখেন হাসপাতালে একজন ডাক্তারও নেই। যেখানে রোগীরা ডাক্তার পাচ্ছে না, ওষুধ পাচ্ছে না সেখানে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বসার রুম ও সভাকক্ষ এসি ও ডেকোরেশন সাজাতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করছেন।
 এ বিষয়ে সাটুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মামুন উর রশিদ ডাক্তার সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, সাটুরিয়া হাসপাতালে যেসব ডাক্তার দেওয়া হয়েছে বেশিরভাগ ডাক্তারই নারী। এদের মধ্যে অনেকে গর্ভবতী। তারা মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। অনেকে ডেপুটেশনে রয়েছেন। যে কারণেই ডাক্তার সংকট দেখা দিয়েছে।

×