ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

গরিবের চাল-ডাল চেয়ারম্যানের পকেটে 

নিজস্ব সংবাদদাতা, বোয়ালমারী, ফরিদপুর

প্রকাশিত: ১৪:৪৫, ৬ জুলাই ২০২৪

গরিবের চাল-ডাল চেয়ারম্যানের পকেটে 

শেখর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ। ছবি: জনকণ্ঠ

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ ও পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে (ভিজিডি কার্ডের) গরিবের চাল-ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ আত্মসাৎের অভিযোগ উঠেছে। উপকারভোগীদের পরিবর্তে চাল-ডাল সহ বিভিন্ন উপকরণ যাচ্ছে চেয়ারম্যানের পকেটে।

ভুক্তভোগীদের নামে আসা সব চাল, ডাল আত্মসাৎ করছেন চেয়ারম্যান নিজেই। বিষয়টি অনেকেই জানতে পেরে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। মাসের পর মাস সরকারি রিলিফের খাদ্য সহায়তা না পেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিকার চেয়েছেন পরিবারগুলো। 

হতদরিদ্র কৃষক স্বামীর সংসারে সরকারি সহযোগিতা পেতে বিগত প্রায় দুই বছর আগে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দ্বারস্ত হয়েছিলেন রোকেয়া বেগম (৫২)। ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের কাছে আকুতি মিনতিতে পাঁচশ টাকার বিনিময়ে পেয়ে যান একটি ভিজিডি কার্ড। প্রথমবার সহযোগিতা পেলেও বন্ধ হয়ে যায় সেই ভাগ্যের দুয়ার। কেড়ে নেওয়া হয় তার সহায়তা কাড। এরপর তার নামে প্রতিবারই আসতে থাকে সরকারি চাল, ডাল সহ বিভিন্ন উপকরণ কিন্তু একবারও পৌঁছেনি তার হাতে। 

শুধু রোকেয়া বেগম নয়- এই ইউপিতে এমনই ৪০ জন ব্যক্তির নামে মাসের পর মাস আসতে থাকে সরকারি সহযোগিতা। তাদের মধ্যে অনেকেই জানেনই না তার নামে কার্ড ইস্যু হয়েছে। কিন্তু উপকারভোগীদের তালিকায় রয়েছে তাদের নাম। এই কার্ডের উপকারভোগীদের পরিবর্তে বরং সেই চাল-ডাল সহ বিভিন্ন উপকরণ যাচ্ছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ৮ নং শেখর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ ও পরিষদের সদস্যদের পকেটে। 

সরেজমিনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে না গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অফিসকে ইউপি কার্যালয়ে রুপান্তরিত করেছেন।

ওই ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের কৃষক ফেরদৌস মোল্যার স্ত্রী রোকেয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, অনেক ঘুরে চেয়ারম্যানকে পাঁচশ টাকা দিয়ে একটা কার্ড পাইছিলাম। কিন্তু তা আমারে অন্য একজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে বলে চেয়ারম্যান এবং তার কাছ থেকে বাকি ২৫০ টাকা নিয়ে নিতে বলে। কিন্তু ওই লোক ভাগে নিতে চায় না। বিষয়টি আমি চেয়ারম্যানকে জানালে সে আমাকে রাগ করে বলে ভাগে খাইলি খাবা নইলে যাও। পরে নত হয়ে একবার আনলাম। পরে আমি চৌকিদারকে (গ্রাম পুলিশ) বললে, চেয়ারম্যান আমার উপর আরও রেগে যায়। এরপর আমার কার্ড রেখে বের করে দেয়। তারপর আজ ১৮/১৯ মাস কোনো চাল ডাল দেয় না। 

গত ১২ জুন জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখর ইউনিয়নে ২৪০টি ভিজিডি কার্ড রয়েছে। এরমধ্যে ইউপি সদস্যদের ৫/৬টি করে কার্ড দিয়ে নিজে কিছু বিতরণ করেছেন। বাকিগুলো বিভিন্ন মানুষের নামে কৌশলে ইস্যু করে চেয়ারম্যান আত্মসাৎ করছেন। এই অভিযোগপত্রে ৩০ জন স্বাক্ষর করেন।  

এই সুবিধাভোগীদের তালিকার ২৪০ ব্যক্তির মধ্যে অনেকেই জানে না তাদের নামে ইস্যু হওয়ার কার্ডের খবর। এদের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে পাঁচশত টাকাসহ তাদের ভোটার আইডি কার্ড, ছবি দিয়েছিলেন ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের কাছে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা জানতেই পারেনি তাদের নামে কার্ড ইস্যু হয়েছে। 

ভিজিডি কার্ডের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে নিজের ও স্বামী বিল্লাল শিকদারের ছবি দিয়েছিলেন রাখালতলী গ্রামের জোসনা বেগম। এরপর জানতে পারেনি তার নামে কার্ড ইস্যু হয়েছে। কিন্তু ভিজিডি কার্ডের তালিকায় ১২৩ নম্বরে নাম রয়েছে তার। এই নারী বলেন, আমাগো নাম ও ছবি নিয়েছিল কিন্তু আজও আমরা কিছু পাইনি। কার্ড হয়েছে কি-না তাও আমি বলতে পারব না।  

এই ভিজিডি কার্ডের তালিকায় নাম থাকা বারাংকুলা গ্রামের দেলোয়ার কাজীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির চারদিকে টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা, ভেতরে আধাপাকা জোড় ঘর রয়েছে, দেখে মনে হবে না কোনো হতদরিদ্রের বাড়ি। অথচ ওই তালিকায় ১২৭ নম্বরে দেলোয়ার কাজীর স্ত্রী লিমা সুলতানার নাম রয়েছে। 

বিষয়টি জানতে চাইলে দেলোয়ার কাজী হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি জানেনই তার স্ত্রীর নামে ভিজিডি কার্ড রয়েছে। তিনি বলেন, আমার জানা মতে কোনো কার্ড নেই। এমন কী কোনো সুবিধাও পাইনি। আমিতো কখনও আবেদনই করি নাই। আল্লাহ জানে কেমনে কি হয়েছে। এটা যে করেছে সে অবশ্যই অপরাধ করেছে। 

ব্যক্তিগত অফিসই পরিষদ, জনগণের ক্ষোভ: 
উপজেলার ২৯টি গ্রাম নিয়ে গঠিত শেখর ইউনিয়ন। মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ হাজার। ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়টি ৮নং ওয়ার্ডের চরশেখর গ্রামে। গ্রামটি ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ গ্রামের নামেই নামকরণ করা হয়েছে ইউনিয়নের। ২০১০-১১ অর্থবছরে ইউনিয়ন কার্যালয়ের আধুনিকায়ন করে নির্মিত হয় দুই তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবন। 

সরেজমিনে দেখা যায়, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স যেন এখন জরাজীর্ণ ও জনশূন্য একটি ভূতুরে ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর একদিনও সেখানে অফিস করেননি কামাল আহমেদ। এমনকি সেখানে কোনো কার্যক্রমই নেই। এই সুযোগে ভবনটিতে অনেকেই গরু ছাগল পালনের কাজে ব্যবহার করছে। অথচ সহস্রাইল বাজারে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলেছেন ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে। দোতলা বিশিষ্ট ভবনের নিচ তলায় বসার জায়গা করা হয়েছে কম্পিউটার অপারেট ও সচিবের। সকল কার্যক্রমই সেখানেই করা হয়। 

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত আড়াই বছর নির্বাচিত হলেও একদিনের জন্যও এখানে অফিস করেননি। যে কারনে হয়রানির শিকার হচ্ছে অনেককে। চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অফিসে গেলে সচিব ও অন্যরা বাড়তি টাকা ছাড়া কাজ করে না। 

দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব বেলায়েত শেখ বলেন, আমাদের দাদার আমল থেকেই এখানে ভোট অফিস দেখে আসতেছি। এ পর্যন্ত যারাই চেয়ারম্যান হয়েছে সকলে এখানেই অফিস করেছে। কিন্তু এই লোক হওয়ার পরে তার চেহারাই আমি দেখি নাই। কিজন্য এই অফিস বন্ধ হয়ে গেছে আমরা জানিনা। আমাদের বাড়তি টাকা দিয়ে তার অফিসে যেতে হয়। সেখানে গেলেও বাড়তি টাকা গুনতে হয়। টাকা ছাড়া কোনো কাজই করতে চায় না।

এসব বিষয়ে জানতে ইউপি চেয়ারম্যান কামাল আহমেদের ব্যক্তিগত অফিস সহস্রাইল বাজারে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ইউপি সচিব বসে অফিস করছেন। এরপরই ওই ইউপি সচিব সেখান থেকে আড়াল হয়ে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে উপস্থিত হোন চেয়ারম্যান।

শেখর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ বলেন, আমার ও পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন। কার্ড আত্মসাত করা কোনোভাবেই সম্ভব না। যতগুলো কার্ড রয়েছে প্রত্যেককেই দেয়া হয়। যত মালামাল আসে সবই সঠিকভাবে বন্টন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের ১০ কেজি চাউল চেয়ারম্যান মেরে দেবে, এটা আমার মাথায় আসে না। আমার বরাদ্দের বেশি থেকেও মানুষকে দিয়ে থাকি। তিনি দাবি করে বলেন, এলাকায় দল পাল্লা থাকে, যে কারণেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক(ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত হবে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের একজনকে কর্মকর্তাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিবে। এতে তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এসআর

×