ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

নিপুণ নকশার কারিগর

লিখন আহমেদ

প্রকাশিত: ০১:২৩, ৫ জুলাই ২০২৪

নিপুণ নকশার কারিগর

উল্লাপাড়ায় দক্ষ হাতে নিখুঁত নকশা আঁকছেন এক কারিগর

নারীর সাজসজ্জায় গহনা ব্যবহারের প্রচলন যুগ যুগ ধরেই। গহনা নারীর রূপকে অনেক বেশি অপরূপ করে তোলে। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত নারীদের সোনার গহনার প্রতি আলাদা এক ধরনের অনুরাগ রয়েছে। সাধ্যের মধ্যে একটু হলেও স্বর্ণালঙ্কার কেনার ইচ্ছা থাকে সব শ্রেণি পেশার মানুষের। আদিকাল থেকেই স্বর্ণের প্রতি নারী-পুরুষের বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। বিশেষ করে নারীর রূপসজ্জায় স্বর্ণালঙ্কারের জুড়ি নেই। বিয়ে কিংবা যেকোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় যুবতী থেকে বৃদ্ধ বয়সি নারীরা তাদের সাধ্যমতো স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে তোলেন।

অনেকে শখের বশে স্বর্ণালঙ্কার কিনতে পছন্দ করেন। গ্রামবাংলার গৃহবধূরা ধান, পাট গরু ছাগল এমনকি হাঁস-মুরগি বিক্রি করে হলেও সোনার গহনা কেনেন। উচ্চবিত্ত নারীরা বিদেশে যান সোনার গহনা কিনতে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষেরই এই ধাতব পদার্থটি পছন্দের বস্তু। স্বর্ণালঙ্কার শুধু নারীদের পছন্দ তা নয় পুরুষেরাও শখ করে স্বর্ণ ব্যবহার করেন। গ্রাম অঞ্চলে বিয়েতে যৌতুক হিসেবেও স্বর্ণালঙ্কার আদান-প্রদান করা হয়। সোনা দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের গহনা বা অলঙ্কার তৈরির কারিগরকে আমরা স্বর্ণকার বলে থাকি।
আমরা স্বর্ণকারের দোকানে গেলে দেখতে পাই, স্বর্ণকাররা কুপিবাতি জ্বালিয়ে শ্বাস ধরে বাঁকনলে ফুঁ দিয়ে সোহাগা দিয়ে সোনা-রুপা গলিয়ে ছাঁচে ঢালেন। ঠান্ডা হলে হাতুড়ি দিয়ে টুংটাং শব্দে পিটিয়ে প্রয়োজনবোধে গলানো সোনা-রুপা থেকেই চিকন শনের ধারালো মুখ ব্যবহার করে নকশা তোলেন। এভাবেই স্বর্ণকাররা বানিয়ে ফেলছেন নারীর সৌন্দর্য আর আভিজাত্যের অহংকার চকচকে নিখুঁত সোনা-রুপার গহনা। স্বর্ণকারদের এ কাজগুলো খুব একটা সহজ বললে ভুল হবে। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে মেধা মনন দিয়ে তারা এ কাজগুলো করে থাকেন। 
একসময় এ কারিগরদের কদর অনেক বেশি থাকলেও বর্তমানে খুব একটা কদর নেই বললেই চলে। শীতকালে বিবাহের সিজন উপলক্ষে স্বর্ণকারদের কাজের কিছুটা চাপ থাকলেও অন্যান্য সময় বেকার বসে থাকতে হয় বলে জানিয়েছেন অনেকে। এর মূল কারণ সোনার মূল্য বৃদ্ধি, আধুনিক ইমিটেশন জুয়েলারির আগমনকে দায়ী করেছেন স্বর্ণকার ও সোনা ব্যবসায়ীরা।

দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ প্রয়োজন ও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্বর্ণ ব্যবহার করতে পারছেন না। এবং ইমিটেশনের ব্যবহার বাড়ায় মানুষ অধিক দামে স্বর্ণ ব্যবহারের পরিবর্তে ইমিটেশনের দিকে ঝুঁকছেন ফলে স্বর্ণের দোকানে ক্রেতা সংকট দেখা দিচ্ছে। পর্যাপ্ত ক্রেতা না পাওয়ায় অনেক স্বর্ণকার বেকার দিন কাটাচ্ছে। কাজ না থাকায় অনেকেই পূর্ব পুরুষের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। 
স্বর্ণকারের দোকানে মেয়ের জন্য নাকফুল কিনতে আসা সুফিয়া খাতুন নামে এক গৃহবধূ বলেন, প্রত্যেক নারীরই সোনার গহনা পরার শখ থাকে। বর্তমানে সোনার যে দাম তাতে আমরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সোনার গহনা পরতে পারি না। বিয়ে কিংবা অন্যান্য অনুষ্ঠানে সোনার পরিবর্তে এখন ইমিটেশনের গহনা পরেন নারীরা। অতি প্রয়োজন না হলে স্বর্ণকারের দোকানে আসা হয় না। মেয়ের জন্য একটা নাকফুল কিনতে এসে বুঝতে পারছি সোনার গহনা আমাদের মতো লোকদের নাগালে বাইরে চলে গেছে।

উল্লাপাড়া উপজেলার পাটধারী বাজারের স্বর্ণকার লিটন হোসেন। তিনি দুই যুগের বেশি সময় ধরে এ পেশার সাথে জড়িত আছেন। তিনি বলেন, এক সময় এ পেশা খুবই জমজমাট ছিল। দোকানে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকতো। তখন বিয়ের সিজন ছাড়াও সবসময় ক্রেতাদের চাপ থাকত। আশপাশের স্বর্ণকারদের অধিক উপার্জন আর সচ্ছল জীবনযাপন দেখেই স্বর্ণের কাজে এসেছিলাম। তখন গ্রামাঞ্চলের নারীদের মধ্যে সোনা গহনার আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল। দিনরাত কাজ করেও কাজ শেষ হতো না। এখন শহরের বড় বড় দোকান বা শোরুমগুলোতে হয়তো মানুষের উপস্থিতি আছে।

তবে মফস্বল এলাকার আমাদের মতো ছোট দোকানের কার্যক্রম কমেছে। লগ্নি যারা বেশি করতে পারছেন তারা ব্যবসা করতে পারছেন। আর আমরা যারা ছোট পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করছি তাদের জন্য জীবন-যাপন করাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অনেক স্বর্ণকার কাজ না পেয়ে বেকার হয়ে বসে আছেন। সপ্তাহে দুয়েকটা কাজও মিলছে না। কাজ না পাওয়ায় অনেক কারিগর পেশা পাল্টেছে। যারা এ কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ জানে না তারা অতি কষ্টেও এ পেশা ধরে আছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ক্রেতা সংখ্যা খুবই কম, মাঝে দুয়েকজন যা আসেন তারা যখন সোনার গহনা  তৈরি করতে দেয় তখন পুরো টাকা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও দেয় না। ১ লাখ টাকার কাজে হয়তো ১০ হাজার টাকা দিয়ে যায়। এক সপ্তাহ পরে যখন নিতে আসে তখন সোনার দাম বাড়তি থাকলেও আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে কিছুই বলতে পারি না। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে বেচাবিক্রি নিয়ে আমাদের বিপাকে পড়তে হয়।

সোনার দাম বাড়ায় একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ আমাদের দোকানে আর আসে না। একসময় আমার এই দোকানে তিনজন কারিগর ছিল সম্প্রতি কাজের অর্ডার কমে যাওয়ায় এখন আমি নিজেই টুকটাক কাজ করছি। আমরা দেশীয় ডিজাইনের গহনা তৈরি করে অভ্যস্ত। কিন্তু বর্তমানে মানুষ রেডিমেড গহনার প্রতি বেশি ঝুঁকেছেন। যার ফলে অর্ডারের সংকট চলছে। শুধু রেডিমেড নয় সিটি গোল্ড (ইমিটেশন গহনা) ও বিকল্প পণ্যের প্রতিও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এসব কারণেই মূলত স্বর্ণকারদের কাজের পরিধি দিন দিন কমে যাচ্ছে। পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। 
লিখন আহমেদ, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ

×