ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

কিভাবে তৈরি হয় গহনা

অঙ্গন সাহা

প্রকাশিত: ০১:২১, ৫ জুলাই ২০২৪

কিভাবে তৈরি হয় গহনা

স্বর্ণকারদের ঘামে শ্রমে তৈরি পরিপাটি অলঙ্কার দিয়ে সেজেছেন এক কনে 

আদিকাল থেকেই স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। নানার ডিজাইন আর ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি এসব সোনার অলংকার যুগ যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে এলেও আজও ভাটা পড়েনি এর চাহিদায়। কিন্তু কিভাবে একটি স্বর্ণ খ-কে চমৎকারভাবে নানান ডিজাইনে অলংকারে রূপ দেন এর কারিগররা সেই কৌতূহল যেন সবার মধ্যে।
দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত ঢাকার সাভার নামাবাজার স্বর্ণ পট্টিতে কারিগর হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করা কৃষ্ণ সাহার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ এই কারিগর জানান, সাধারণত মানুষের মধ্যে যেই ধারণা রয়েছে যে, হয়তো কোনো স্বর্ণ খ-কে মুহূর্তেই কোনো ধাতব যন্ত্রে ফেলে কারিগররা তৈরি করে ফেলেন নানান ঢঙের সোনার গহনা, বিষয়টি আসলে তেমন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সনাতন পদ্ধতির নানান প্রযুক্তি। 
সাধারণত আমরা অলঙ্কার তৈরির জন্য ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ সংগ্রহ করে থাকি। অনেকের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে এই ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়েই মনে হয় অলঙ্কার ভালো হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো শুধু ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে কোনো অলংকার তৈরি সম্ভব না, এর জন্য প্রয়োজন খাদ। শুনতে অবাক লাগলেও এটিই সত্য’, বলছিলেন কৃষ্ণ সাহা। গহনা তৈরির কারিগররা জানান, ২৪ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের সঙ্গে দেড় আনা তামা ব্যবহার করা হয়, এর সঙ্গে পরিমাণ মতো মিশানো হয় সোহাগা। এই মিশ্রণের পর এই স্বর্ণ কোয়ালিটি নেমে আসে ২২ ক্যারেটে।

একইভাবে স্বর্ণকে ২১ ক্যারেট করতে এই তামার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয় ভরিতে ২ আনা পর্যন্ত। একইভাবে ২০ ক্যারেট করতে তামার প্রয়োজন ৪ আনা পরিমাণ আর ১৮ ক্যারেটে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬ আনা পর্যন্ত। 
ক্যারেট পরিবর্তনের পর শুরু হয় অলংকার তৈরির প্রক্রিয়া। প্রথমে তামা মিশ্রিত এ স্বর্ণকে গলিয়ে তৈরি করা হয় স্বর্ণের পাত, কেউবা এটিকে অনেকটা দড়ি আকারে তৈরি করে। এরপর সেই পাত বা দড়ি আকারের স্বর্ণ কেটে ছোট ছোট টুকরা করেন কারিগররা।
গয়না তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে কালচে মোমের প্রলেপ দেওয়া বোর্ডের ওপর এসব স্বর্ণের ছোট ছোট টুকরাগুলো ক্রেতার পছন্দের ডিজাইন অনুযায়ী বসানো হয়। এই মোমগুলো আসলে এক ধরনের কালো মাটি যা ভারত থেকে আনা হয়, যা থেকে তৈরি করা হয় ছাচ।
পরবর্তীতে এই ছাচে ফেলে স্বর্ণের টুকরাগুলো আগুনের সাহায্যে গলিয়ে বিভিন্ন নকশা করা হয়, নকশা তৈরি হয়ে তার ওপর ঢালা হয় এক প্রকার সাদা চুনের মতো প্লাস্টার, এরপর শুরু হয় ঝালাইয়ের কাজ, ক্যারিয়ম ও দস্তা মিশ্রিত রাসায়নিক দিয়ে ঝালাই শেষে মোটামুটি তৈরি হয়ে যায় অলংকার।
কিন্তু এই অবস্থায় এসে সোনার গহনাগুলো কিছুটা কালচে বর্ণের হয়ে যায়, তাই সবশেষ সালফার এসিডে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রেখে এসব গহনা পরিষ্কার করে প্রস্তুত করা হয় গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
তবে এই পুরো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয় সনাতন পদ্ধতিতে, যাতে হাতুড়ি, নিয়াই, শুন, কাতানিসহ বিভিন্ন হাতের যন্ত্রে পুরো কাজ শেষ করেন কারিগররা।
স্বর্ণের কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি সীতাহার তৈরিতে সময় লাগে ৫ দিন, আংটি বানাতে ১ দিন, চেন তৈরিতে ২ দিন, কানের ঝুমকা তৈরিতে ৩দিন, হাতের বালা তৈরিতে ৫ দিন সময় লাগে। এসব বানাতে কারিগরদের পারিশ্রমিক ভরি হিসেবে দেওয়া হয়। 
সাভার নামাবাজারের স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যবসায়ী জনকল্যাণ সমিতির সভাপতি প্রদীপ কুমার দাস বলেন, আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বর্ণের চাহিদা বেশি থাকলেও সময়ের সঙ্গে এই ধাতুর মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে, আর ডিজাইনেও এসেছে অনেকটা তারতম্য। তিনি জানান, বর্তমানে নামাবাজারে স্বর্ণ ব্যবসায়ী রয়েছেন অন্তত ২০০ জন, এছাড়াও কারিগর রয়েছেন ৩০০ জনেরও অধিক।
অঙ্গন সাহা, সাভার

×