ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

স্বর্ণ শিল্পীদের দুর্দিন

নজরকাড়া গহনার কারিগর

অভিজিৎ রায়

প্রকাশিত: ০১:২০, ৫ জুলাই ২০২৪

নজরকাড়া গহনার কারিগর

ব্রিটিশ আমল থেকেই ফরিদপুরে সোনার দোকানগুলোতে স্বর্ণকারিগররা গহনা তৈরি করে আসছেন

প্রাচীন কাল থেকে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম পরিধেয় ছিল সোনা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীরা সোনার অলংকার পরে অংশগ্রহণ করত। বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাঙালিদের উপহার প্রদানের ক্ষেত্রে সোনা ছিল প্রথম পছন্দ। বাঙালি হিন্দুরা তাদের ঠাকুর দেবতার উদ্দেশে সোনা/রুপা মানত করতো। মোটকথা বাঙালির উৎসবের সব স্থানেই সোনার প্রচলন ছিল। কালক্রমে সোনার ব্যবহারে ভাটা পড়ে। সোনা হয়ে ওঠে উচ্চবিত্তদের শৌখিনতা। মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় শুধু বিয়েশাদিতে কিছুটা স্বর্ণ প্রদান করাটাই মধ্যবিত্তরা সোনার ব্যবহার ধরে রেখেছেন।
ব্রিটিশ আমল থেকেই ফরিদপুরে সোনার দোকানগুলো তাদের ব্যবসা শুরু করে। সোনার দোকানকে কেন্দ্র করে এক নতুন শ্রেণি তৈরি হয় ফরিদপুরে। সেটা হলো কর্মকার সম্প্রদায়। সোনার দোকানের মালিক ছাড়াও সোনার দোকানের কর্মচারী এবং স্বর্ণ তৈরির কারিগর শ্রেণি তৈরি হয়। ফরিদপুরে প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র নিলটুলীতে সোনার ব্যবসা শুরু হয়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই সোনার একচেটিয়া বাজার এখন পর্যন্ত ধরে রেখেছে নিলটুলি কেন্দ্রিক সোনার ব্যবসায়ীরা। এখনো নিলটুলিকে সারাদেশের সবাই স্বর্ণকার পট্টি হিসেবে চেনে।
ফরিদপুর শহরের নিলটুলির প্রবীণ বাসিন্দা অশোক কুমার দত্ত (৭০) বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই ফরিদপুরে সোনার ব্যবসা শুরু হয়। এখানকার নিলটুলীতে প্রথমে হাতে গোনা কয়েকটি দোকান ছিল। এই দোকানগুলোতে অল্প কিছু স্বর্ণকার দোকানে সোনা বেচাকেনা করত। আমার জানামতে ফরিদপুরের নিলটুলীতে সর্বপ্রথম সোনার ব্যবসা শুরু করে দত্ত জুয়েলার্স। এই দোকানের মালিক ছিল রাজেশ্বর দত্ত। তিনি তার কয়েকজন কর্মচারী দিয়ে দোকান পরিচালনা করতেন।

পরবর্তীতে আরও কয়েকজন স্বর্ণকার এই ব্যবসায় আসেন। তারা হলেনÑ এনসি কর্মকার যার মালিক ছিল যতীন্দ্রনাথ কর্মকার, দত্ত স্বর্ণালয় যার মালিক ছিল ভোলানাথ দত্ত, রমেশ কর্মকারের দোকান, দে জুয়েলার্স যার মালিক ছিল শচীন্দ্রনাথ দে। এসব দোকানদারের অনেক বংশধররা এখনো নিলটুলীতে সোনার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সে সময় কলকাতা থেকে ফরিদপুরে সোনা ও রুপা আসতো। এখানকার কারিগররা সেই সোনা এনে ভেঙে নতুন অলংকার তৈরি করত। সোনার নতুন অলংকারের জন্য কলকাতার ওপর নির্ভরতা ছিল।
ফরিদপুরে বর্তমানে নিলটুলীতে শতাধিক সোনা রুপার দোকান আছে। ফরিদপুর জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) এর সভাপতি নন্দ কুমার বড়াল জানান, সমগ্র ফরিদপুর জেলায় প্রায় ৫০০টি সোনার দোকান ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলার মধ্যে বাজুসের সদস্য হয়েছে ২১৩জন মালিক। এছাড়া বাজুস সদস্য ব্যতীত আরও  শতাধিক দোকান রয়েছে। শুধু নিলটুলীতেই ১৫০ টির মতো দোকান রয়েছে।
ফরিদপুর জেলা স্বর্ণশিল্পী শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সজল কুমার দত্ত জানান, ফরিদপুর জেলায় প্রায় ১২০০  জন স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক রয়েছে। ফরিদপুর সদর উপজেলায় ২৫৭জন তাদের সমিতির সদস্য। এছাড়া সমিতির সদস্য এর বাইরে প্রায় ২০০ জন শ্রমিক জেলায় স্বর্ণ কারিগর হিসেবে কাজ করে।
ক্রমবর্ধমান সোনার দামের বৃদ্ধি, অসচ্ছলতা, সোনা রাখা বা পড়ায় ঝুঁকির কারণে দিনে দিনে দেশে সোনার কেনাবেচা একেবারইে কমে গেছে। ফলে সারাদেশের মতো প্রভাব পড়েছে ফরিদপুরের সোনার কারিগরদের ক্ষেত্রেও। নতুন করে সোনা শিল্পে নতুন কোনো কারিগর আসছে না। পাশাপাশি সোনার অলংকার এখন মেশিনে তৈরি করা হচ্ছে। এর ফলে স্বর্ণ শিল্পীদের চাহিদা কমছে। নিজ পেশায় আয় কমে যাওয়ায় স্বর্ণ শিল্পীরা এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
ফরিদপুর জেলা স্বর্ণশিল্পী শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি সজল কুমার দত্ত জানান, ফরিদপুরে বর্তমানে সোনার কারিগররা এই পেশায় থেকে নিজের ও পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে পারছে না। সোনার দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে সোনার শোরুমের সংখ্যা। কিন্তু কমে গেছে স্বর্ণ কারিগরের সংখ্যা। ফলে তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। কিছু সোনার দোকানের মালিক টিমেতালে তাদের দোকান টিকিয়ে রেখেছে।

সোনা বেচাকেনার পরিমাণ কমে যাওয়ায় অধিক লাভের আশায় এবং ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অধিকাংশ দোকানদার সোনা বন্ধকের ব্যবসায় ঝুঁকেছে। পাশাপাশি কিছু দোকানদার সোনা কেন্দ্রিক অনৈতিক ব্যবসায়ও ঢুকেছে। আমরা চেষ্টা করছি এই ব্যবসা থেকে অনৈতিক ব্যবসা দূর করতে।
নিলটুলিতে ঘুরে অধিকাংশ সোনা তৈরির কারখানাতেই দেখা গেছে অল্প কিছু স্বর্ণ কারিগররা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই পেশায় স্বচ্ছলতা আনতে না পেরে স্বর্ণ শিল্পীদের বিরাট অংশ পেশা ছেড়ে চলে গেছে। সৃষ্টিশীল এই কাজে এখন নেই নিরাপত্তা পর্যাপ্ত সহযোগিতা।
ফরিদপুর জেলা স্বর্ণশিল্পী শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শীতল কর্মকার নয়ন জানান, স্বর্ণ ব্যবসায় স্বর্ণ তৈরির সময় ৫টি স্তরে কাজ হয়, এর মধ্যে তৈরিকারক, পালিশকারী, ছিলাকারী, নকশাকারক ও হলমার্ক এর কাজ করা হয় এই রকম ৫টি ধাপ পার হয়ে একটি সোনার অলংকার ক্রেতার কাছে পৌঁছায়। এখন রেডিমেড সোনার অলংকারের কারণে কোনো ধাপেই স্বর্ণ কারিগররা কাজ পাচ্ছে না। ভারত, সিঙ্গাপুর, চীন, দুবাই থেকে রেডিমেডভাবে সোনার অলংকার দেশে চলে আসছে। সেগুলো বিভিন্ন শোরুমে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। কাজ পাচ্ছে না দেশীয় কারিগররা। 
বাজুস ফরিদপুর জেলা শাখার সদস্য সঞ্জয় কর্মকার জানান, সোনার অলংকার ব্যবসায়ী কোনো সরকারি সহযোগিতা পায় না। প্রবীণ ও অক্ষম সদস্যদের কোনো পর্যায় থেকেই সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয় না। এদুটো ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হলে সোনা ব্যবসায়ীদের হৃতগৌরব ফিরে আসবে।
ফরিদপুরে সোনার ব্যবসা কমে যাওয়ার পরেও কয়েকটি পরিবার এখন পর্যন্ত বংশ পরম্পরায় তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এরকম একটি পরিবার হলো দত্ত পরিবার। এই পরিবার কয়েক পুরুষ ধরে তাদের সোনার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবারের সদস্য সজল কুমার দত্ত জানান, আমাদের পরিবার ৭০ বছর ধরে নিলটুলীতে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমার ঠাকুরদাদা রাম প্রসাদ দত্ত প্রথমে নিলটুলীতে এই ব্যবসা শুরু করেন। এর বাবা বিজয় কৃষ্ণ দত্ত এবং কাকা বাদল দত্ত ব্যবসা করেছেন। এখন করছি আমরা ৪ ভাই। তবে ব্যবসার যে অবস্থা আমি চাই না আমাদের পরবর্তী বংশধররা এই ব্যবসায় আসুক। স্বর্ণ শিল্পীদের সঙ্গে কেউ মেয়ে বিয়েও দিতে চায় না।
তিনি জানান, স্বর্ণ শিল্পীরা অল্প জায়গায় ঘিঞ্জি পরিবেশে কাজ করে। এসিডের সঙ্গে কাজ করতে হয়। ফলে এই শিল্পীরা বিভিন্ন অসুখে ভোগে। অল্প বয়সে মারা যায়। আগে একজন অভিভাবক তাদের ছেলেকে এই ব্যবসায় নিজে ইনভেস্ট করে ঢোকাতে চাইতো। এখন হাজার চেষ্টা করেও নতুন কোনো ছেলেকে এই ব্যবসায় আনতে পারছি না। ফলে এই ব্যবসা দিনে দিনে হারিয়ে যাবে। সে স্থান দখল করে নেবে বিদেশী অলংকারের বাজার।
অভিজিৎ রায়, ফরিদপুর

×