আনোয়ারুল আজিম আনার
ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যা মামলার তদন্তে নতুন মোড় নিয়েছে। তদন্তের পর্যায়ে এমপি আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় দায় স্বীকার করে আদালতে দেওয়া জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছে তিন আসামি। এমনকি রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের নির্যাতন করার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে আদালতের শুনানিতে দাবি করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। কারাবিধি অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষকে আসামিদের চিকিৎসার নির্দেশ দেন আদালতের বিচারক।
আদালতে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করার ঘটনায় এমপি আনার খুনের মামলার ভবিষ্যৎ অনেকটাই কুয়াশাচ্ছন্ন। এমপি আনার গত ১৩ মে ভারতের কলকাতায় খুন হওয়ার ৫১ দিন পরও তার লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এমনকি তাকে খুন করার যেসব আলামত আছে তাও খুঁজে পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে তিন আসামি জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করায় এখন এমপি আনার খুন হওয়ার ঘটনাটাই বিচারিক আদালতে প্রমাণ করাটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হবে। রিমান্ডে আসামিদের নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠায় তদন্ত সংস্থাকেও পক্ষপাত দোষের অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। সোনা চোরাচালানকেন্দ্রিক বিরোধ ও লেনদেনের জের ধরে হত্যাকা-ের তদন্তের মধ্যে হঠাৎ করে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এসে পড়ায় নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
সোনা চোরাচালানি মাফিয়া চক্র প্রভাবশালী মহলে প্রভাব বিস্তার করে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের মাধ্যমে খুনের মোটিভ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পর্দার অন্তরাল থেকে কলকাঠি নাড়া শুরু করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আদালত, তদন্ত সংস্থা সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় দায় স্বীকার করে দেওয়া জবানবন্দি আদালতে প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন যে তিন আসামি তারা হচ্ছে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুঁইয়া ওরফে আমানুল্যাহ সাঈদ ও তানভীর ভুঁইয়া।
বৃহস্পতিবার আসামিদের জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন শুনে নথিভুক্ত করে রাখার আদেশ দিয়েছেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মাহবুবুল হক। আদালতে আসামিদের উপস্থিতিতে তাদের পক্ষে শুনানি করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক সরকারি কৌঁসুলি এহসানুল হক সমাজীসহ কয়েকজন আইনজীবী। শুনানিতে অভিযোগ করা হয়েছে, আসামিরা রিমান্ডে নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা বলে চিকিৎসার আবেদন করেন। কারাবিধি অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষকে চিকিৎসার নির্দেশ দেন বিচারক।
আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, আসামি বাবুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রত্যাহারের শুনানি করা হয়েছে। আদালতে জানানো হয়েছে, আসামি বাবুর জবানবন্দিতে যে বক্তব্য বলা হয়েছে সেটা সত্য ও ইচ্ছাকৃত না। এই বক্তব্য তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলানো হয়েছে। মূলত মামলাটি তদন্তাধীন। তদন্তাধীন কোনো মামলায় আসামির দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি জনসম্মুখে প্রকাশ করার একটা বাধা রয়েছে। কারণ এটা হচ্ছে প্রাইভেট ডকুমেন্টস। এটা নিয়ে বক্তব্য দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। কি করে গণমাধ্যমে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রকাশ পেল?
তদন্তনাধীন স্পর্শকাতর বিষয়ে হুবহু বক্তব্য গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ বেআইনি বলেও দাবি করেন আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। তিনি বলেন, জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদনটি এখন নথিতে থাকবে। এর গুরুত্ব তৈরি হবে- যখন আসামিপক্ষ ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামির পরীক্ষা আত্মপক্ষ সমর্থনের দিন এই আবেদনের কারণ যথার্থতার মেলবন্ধন করতে পারেন। তিনি জানান, ততদিন এ আবেদন নথিতে ঘুমিয়ে থাকবে, জেগে উঠবে আত্মপক্ষ সমর্থনের দিন। সেদিন যৌক্তিক মনে করলে বিচারিক আদালত এ আবেদনের বক্তব্য অর্থাৎ জোর করে নেওয়া, কারসাজি করা জবানবন্দি আমলে নেবেন।
আগামী ৮ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ ॥ এমপি আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় আগামী ৮ আগস্টের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ঠিক করা ছিল। কিন্তু তদন্ত সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এ কারণে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মাহবুবুল হক প্রতিবেদন দাখিলের নতুন দিন ঠিক করেন বলে জানান আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা এসআই জালাল উদ্দিন।
অইন বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, ভারত গিয়ে খুন হওয়া বাংলাদেশের এমপি আনার হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। হত্যার ঘটনার বর্ণনা ও অপরাধীদের স্বীকারোক্তি পেলেও তার দেহাবশেষ পাওনা না গেলে হত্যা মামলার বিচারকাজ অসম্পূর্ণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক তল্লাশি চালিয়েও এখন পর্যন্ত এমপি আনারের লাশ খুঁজে পায়নি। এ ছাড়াও তার দেহের খ-িত অংশ পাওয়া নিয়েও নানা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কারণ হিসেবে জানা গেছে, ঘাতকরা এমপি আনারকে হত্যার পর লাশ গুম করতে টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছে। হত্যা মামলায় অবশ্যই দৃশ্যমান প্রমাণ থাকতে হবে। প্রথমত, সত্যতা লাগবে হত্যা মামলার ভিকটিম জীবিত নাকি মৃত। এরপর তিনি মারা যাওয়ার তথ্য থাকলে তার মৃত্যুর ঘটনার দৃশ্যত আলামত লাগবে। যদি হত্যার শিকার ব্যক্তি বা ভিকটিমের লাশ বা দেহ একেবারেই না পাওয়া যায়, তবে সেই হত্যা মামলা একটা পর্যায়ে এসে টেকানো যায় না।
ঢাকা মহানগর আদালতের একজন আইনজীবী জানিয়েছেন, হত্যার বর্ণনা ও ঘটনায় অপরাধীরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলে সেই মামলা প্রমাণ হয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করা হলেও একটা পর্যায়ে এই আসামিরাই বলে থাকেন, তাদের দিয়ে জোরপূর্বক জবানবন্দি শিখিয়ে বলানো হয়েছে। তখন হত্যার আলামত না থাকলে মামলার বিচার কাজে বেগ পেতে হয়। এক সময় দেখা যায় ঘটনা সত্য হলেও সঠিক প্রমাণের অভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। হত্যা মামলার ক্ষেত্রে দালিলিক এবং দৃশ্যমান প্রমাণ লাগবেই।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম জানিয়েছেন, হত্যা মামলায় লাশ বা দেহাবশেষ না পেলে সেই মামলা একটা সময় টিকবে না। মামলার বিচার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিত করে থাকলেও তারা পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এক্ষেত্রে বেশি থাকে। তিনি বলেছেন, অপরাধীরা আদালতে হত্যার স্বীকারোক্তি দিলে সেটা মামলার চার্জশিটে কাজে লাগবে, এতে চার্জশিট হতে পারে, তবে বিচারকাজ সম্পন্ন করতে হলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন লাগবেই।
এ ছাড়া মৃতদেহের আলামত লাগবে। এমপি আনার হত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অবশ্যই এমপি আনারের হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করতে হলে তার লাশ বা দেহের অংশ লাগবে। মরদেহের অংশ ছাড়া হত্যা মামলার বিচার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তবে হত্যার ঘটনায় জড়িত কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও এখন পর্যন্ত হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে পারেনি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।