ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১

আদালতে ফয়সালের জবানবন্দি

মুখে ক্লোরোফর্ম মিশ্রিত রুমাল চেপে অচেতন করে খুনে অংশ নেই

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ৩ জুলাই ২০২৪

মুখে ক্লোরোফর্ম মিশ্রিত রুমাল চেপে অচেতন করে খুনে অংশ নেই

আনোয়ারুল আজিম আনার

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা ও অপহরণ মামলায় আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আসামি ফয়সাল আলী শাহাজী। ফয়সাল আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, এমপি আনার পরিকল্পনা বিষয় বুঝতে পেরে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে তাকে পেছন থেকে গলায় ধরে মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম মিশ্রিত রুমাল দিয়ে চেপে ধরে অচেতন করে সহযোগীদের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছি।

আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে ফয়সালকে। বুধবার ফয়সাল আলী শাহাজীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে। এদিন ছয়দিনের রিমান্ড শেষে ফয়সালকে আদালতে হাজির করেন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। এরপর আসামি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ডের আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

এর আগেরদিন মোস্তাফিজুর রহমান ফকির একই আদালতে স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এমপি আনার হত্যাকা-ে এ নিয়ে ছয় আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারেক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে এখন আর কোনো আসামি নেই, যারা জবানবন্দি দেবেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে একজন সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডের মামলার এখন শুধুমাত্র জবানবন্দি নির্ভরশীল তদন্ত হয়ে উঠেছে। হত্যাকাণ্ডের এক মাস বিশদিন পরও লাশ উদ্ধার বা শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এমপি আনারকে যে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে তার কোনো আলামত উদ্ধার করা যায়নি। শুধুমাত্র জবানবন্দি নির্ভরশীল তদন্তে এমপি আনার হত্যাকা-ের মামলার বিচারের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের দাবি। আদালত ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
ফয়সাল জবানবন্দিতে বলেছে, এমপি আনার হত্যার পরিকল্পনা বিষয় বুঝতে পেরে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাকে পেছন থেকে গলায় ধরে মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম মিশ্রিত রুমাল দিয়ে চেপে ধরে অচেতন করে ফেলি। মোস্তাফিজুর রহমান ও অন্যরা তার মৃত্যু নিশ্চিত করে বিবস্ত্র মৃতদেহ চেয়ারে বেঁধে ছবি তোলে। এমপি আনারকে হত্যা করার জন্য তাদেরকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় বড় অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে।

আমাকে (ফয়সাল) ও মোস্তাফিজকে এমপি আনার হত্যার জন্য পাসপোর্ট তৈরি, মেডিক্যাল ভিসা পেতে ব্যাংক স্টেটমেন্ট তৈরি, রোগের প্রেসক্রিপশনসহ যাবতীয় কাজ করে দেন হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন। চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া তাদের বড় অঙ্কের টাকার লোভ দেখিয়ে এমপি আনার হত্যায় যুক্ত করেন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ছাড়াও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে রিমান্ডে এমন তথ্যই জানিয়েছে ফয়সাল আলী শাহাজী।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার মোস্তাফিজুর রহমান দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেওয়াতে এ মামলায় এখন পর্যন্ত ছয়জন আদালতে জবানবন্দি দিলেন। পুলিশ বুধবার আসামি ফয়সালকে আদালতে হাজির করলে তিনি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান।

আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে গত ২৬ জুন এ মামলায় দুই পলাতক আসামি ফয়সাল আলী সাজী ওরফে ও মোস্তাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি দল। ওইদিন দুপুর থেকে হেলিকপ্টারে খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে ডিবি। ২৭ জুন দুই আসামিকে আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে ডিবি পুলিশ।

ওইদিন শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতাউল্লাহ তাদের ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে এ মামলায়  সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া, শিলিন্তি রহমান, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, মোস্তাফিজুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বুধবার ফয়সাল আলী শাহাজী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বর্তমানে আসামিরা কারাগারে রয়েছেন। এ ছাড়া ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু বর্তমানে কারাগারে আছেন।
বুধবার আদালতে হাজির করা হলে ফয়সাল জবানবন্দিতে এমপি আনার খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত স্বীকার করেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে এমপি আনারকে খুনে সরাসরি অংশ নিয়েছে।

শিমুল ভূঁইয়া ও আক্তারুজ্জামান শাহীনের পরিকল্পনা মোতাবেক আমাকে (মোস্তাফিজ) বড় অংকের অর্থ দেবেন বলে জানায়। এরপর গত ২ মে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় নিয়ে হোটেলে রাখেন। তারপর হোটেল থেকে আমি (ফয়সাল) কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের বাসায় উঠি। এমপি আনার ১২ মে কলকাতায় যান এবং ১৩ মে অন্য সহযোগীদের প্রলোভনে শিমুল ভূইয়ার সঙ্গে সঞ্জীবা গার্ডেনের বাসায় যান।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিমুল ভূঁইয়ার নির্দেশে আমি (ফয়সাল) মোস্তাফিজ, জিহাদ, সিয়ামকে নিয়ে এমপি আনারকে হত্যার কার্যক্রম শুরু করি। জবানবন্দিতে ফয়সাল বলেন, এমপি আনারকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে প্রলুব্ধ করে বাংলাদেশ থেকে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে নেওয়া ও হত্যা করে লাশ গুম করা পর্যন্ত শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদসহ আমরা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছি।

এমপি আনারকে অপহরণ ও হত্যাকা-ের ঘটনা প্রকাশিত হয়ে গেলে সহযোগী মোস্তাফিজকে নিয়ে আমি (ফয়সাল) নিজেদের নাম পরিচয় ও চেহারার আকৃতি পরিবর্তন করে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকি। খুনের ঘটনার ১১ দিন আগে কলকাতায় গিয়ে নিউমার্কেট এলাকার একটি হোটেলে উঠি। খুনের ছয়দিন পর ঢাকায় ফিরে আত্মগোপনে চলে যাই। নিজেদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিচয় দিয়ে আশ্রয় নেই চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার পাতাল কালীমন্দিরে। সেখানে হিন্দু পরিচয়ে আশ্রয় নিয়ে ২৩ দিন অবস্থান করে। 
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ২৭ জুন আসামি মোস্তাফিজ ও ফয়সাল আলী শাহাজীর ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। গত ২৬ জুন চট্টগ্রামে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে ডিবির একাধিক টিম। তবে আনারকে হত্যার মিশনে অংশ নেওয়া সাতজনকে গ্রেপ্তারের দাবি করলেও, এখনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে পারেনি ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিকসহ অন্যান্য কারণ আমলে নিয়েই চলছে তদন্ত।
ডিএনএ টেস্টের ভাগ্য আদালতে ॥ এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের ডিএনএ টেস্ট পরীক্ষার দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।
কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হয় মানুষের মরদেহের মাংসপি-। কিন্তু এই মাংসপি- এমপি আনারের কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডরিনের ডিএনএ টেস্ট করানোর জন্য কলকাতায় যাওয়ার কথা। গত ২০ জুন ডিএনএ নমুনা নিতে আনারের মেয়ে ডরিনকে ফোন করে কলকাতার সিআইডি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও জানানো হয়েছে। ডরিনকে দ্রুত সময়ে কলকাতা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। কলকাতার আদালতের অনুমোদন পেলে যেতে বলা হয়েছে তাকে। তবে বুধবার পর্যন্ত কলকাতার সিআইডি ডরিনকে ডিএনএ নমুনা নিতে আদালতের অনুমোদন পায়নি। কলকাতার আদালতের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করছে এমপি আনার কন্যা ডরিনের ডিএনএ নমুনা টেস্টের ভাগ্য।

×