ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৫ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর

আনারের মৃত্যু নিশ্চিত করে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ছবি তুলি

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ০০:০৬, ৩ জুলাই ২০২৪

আনারের মৃত্যু নিশ্চিত করে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ছবি তুলি

আনোয়ারুল আজিম আনার

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ফকির। এমপি আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় গ্রেপ্তার আসামি মোস্তাফিজুর মঙ্গলবার ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে। খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জবানবন্দিতে মোস্তাফিজ বলেছে, হত্যার পরিকল্পনা বিষয় বুঝতে পেরে এমপি আনার কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু পেছন থেকে গলা ধরে মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমাল চেপে ধরে অচেতন করে ফয়সাল আলী সাহাজী। আর আমি (মোস্তাফিজুর রহমান) আনারের মৃত্যু নিশ্চিত করে বিভ্রস্ত্র মৃতদেহ চেয়ারে বেঁধে ছবি তুলেছিলাম। মঙ্গলবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে মোস্তাফিজের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে।

মঙ্গলবার আসামি মোস্তাফিজকে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় সে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান তার জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন। এমপি আনার খুনের মামলায় মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে ছয়দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে  ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

ছয়দিনের রিমান্ডে আনার পাঁচদিনের মাথায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে মোস্তাফিজ। আদালতে জবানবন্দি দেওয়া ছাড়াও মোস্তাফিজ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছেও জবানবন্দি দিয়েছে। অপর আসামি ফয়সাল এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ(ডিবি) হেফজতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আজ বুধবার ফয়সালকে আদালতে পাঠানো হতে পারে এবং এ দিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে পারে বলে ডিবি সূত্রের দাবি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার মোস্তফিজুর রহমান দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেওয়াতে এ মামলায় এখন পর্যন্ত পাঁচজন আদালতে জবানবন্দি দিল। পুলিশ মঙ্গলবার আসামি মোস্তফিজুরকে আদালতে হাজির করলে সে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান।

আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে গত ২৬ জুন এ মামলায় দুই পলাতক আসামি ফয়সাল আলী সাজী ওরফে ও মোস্তাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি দল। ওইদিন দুপুর থেকে হেলিকপ্টারে খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে ডিবি।
২৭ জুন দুই আসামিকে আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে ডিবি পুলিশ। ওইদিন শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতাউল্লাহ তাদের ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ মামলায় এর আগে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া, সিলিন্তি রহমান, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বর্তমানে আসামিরা কারাগারে রয়েছে। এ ছাড়া ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু বর্তমানে কারাগারে আছে।

মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হলে মোস্তাফিজ জবানবন্দিতে এমপি আনার খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত স্বীকার করে। জবানবন্দিতে সে বলেছে, খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে এমপি আনারকে খুনে সরাসরি অংশ নিয়েছে। শিমুল ভূইয়া ও আক্তারুজ্জামান শাহীনের পরিকল্পনা মোতাবেক তাকে (মোস্তাফিজ) বড় অংকের অর্থ দেবে বলে জানায়। এরপর গত ২ মে তাকে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় নিয়ে হোটেলে রাখা হয়। ‘হোটেল থেকে আমি (মোস্তাফিজ) ১০ মে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের বাসায় উঠি।

এমপি আনার ১২ মে কলকাতায় যান এবং ১৩ মে অন্য সহযোগীদের প্রলোভনে শিমুল ভূইয়ার সঙ্গে সঞ্জীবা গার্ডেনের বাসায় যান। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিমুল ভূইয়ার নির্দেশে আমি (মোস্তাফিজ) ফয়সাল, জিহাদ, সিয়ামকে নিয়ে এমপি আনারকে হত্যার কার্যক্রম শুরু করি।’ সঞ্জিবার ফ্ল্যাটের ভেতরে এমপি আনার খুনের বিষয়টি আনার বুঝতে পেরে ফ্ল্যাট থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে।

আসামি (মোস্তাফিজ) ও ফয়সাল তাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমাল দিয়ে চেপে ধরি। হত্যা করার পর তার লাশ গুম করতে শিমুল ভূইয়ার নেতৃত্বে ও নির্দেশে আনারের দেহকে কেটে হাড় থেকে মাংস আলাদা করা হয় এবং লাশ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়।
জবানবন্দিতে মোস্তাফিজ জানায়, এমপি আনারকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে প্রলুব্ধ করে বাংলাদেশ থেকে কলকাতার নিউটাউনের বাসায় নেওয়া ও হত্যা করে লাশ গুম করা পর্যন্ত শিমুল ভূইয়া, ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদসহ আমরা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছি। এমপি আনারকে অপহরণ ও হত্যাকা-ের ঘটনা প্রকাশিত হয়ে গেলে সহযোগী ফয়সালকে নিয়ে আমি (মোস্তাফিজ) নিজেদের নাম পরিচয় ও চেহারার আকৃতি পরিবর্তন করে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকি।

খুনের ঘটনার ১১ দিন আগে কলকাতায় গিয়ে নিউমার্কেট এলাকার একটি হোটেলে উঠি। খুনের ছয়দিন পর ঢাকায় ফিরে আত্মগোপনে চলে যাই। নিজেদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিচয় দিয়ে আশ্রয় নেই চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার পাতাল কালীমন্দিরে। সেখানে তারা হিন্দু পরিচয়ে আশ্রয় নিয়ে ২৩ দিন অবস্থান করি। জবানবন্দিতে মোস্তাফিজ জানায়, আনারকে অচেতন করতে চেতনানাশক দিয়েছিলেন ফয়সাল।  আর  সে  (মোস্তাফিজ) চেয়ারে বেঁধে রাখার কাজ করে।

×