ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১

বগুড়ার স্টেশনগুলোর লুপ লাইন দুর্ঘটনার ফাঁদ!

পাঁচদিনের ব্যবধানে দুটি বগি লাইনচ্যুত

মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া অফিস

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ১ জুলাই ২০২৪

পাঁচদিনের ব্যবধানে দুটি বগি লাইনচ্যুত

বগুড়ায় এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনা

বগুড়ায় এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনায় রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে ট্রেন চলাচল নিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে পরপর দুটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুতির ঘটনায় রেললাইন ও ট্রেনের নানা দুর্বলতা বেরিয়ে পড়ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে স্টেশনগুলোর লুপ লাইনের বেহাল অবস্থা। এ কারণে প্রতিমুহূর্তে স্টেশনগুলোতে ট্রেন ক্রসিং হচ্ছে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। শুধু লুপ লাইন নয় মূল লাইনেও রয়েছে জীর্ণ স্লিপারসহ নানা সমস্যা।

স্লিপারের সঙ্গে লাইনের সংযুক্তির কাজে ব্যবহৃত হাজার হাজার স্প্যান্ডেল ক্লিপ লাইন থেকে উধাও হচ্ছে। এ রকম ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ট্রেন। সর্বশেষ রবিবার রাতে বগুড়ার গাবতলী স্টেশনে প্রবেশের সময় সান্তাহার থেকে বোনারপাড়াগামী লোকাল ট্রেনের ৩টি বগি লাইনচ্যুত হলে মূল লাইন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রায় ৩ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া ট্রেনের যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

এর আগে ৫ দিন আগে সুখানপুকুর রেলস্টেশনে ঘটে একই ধরনের যাত্রীদের ব্যাপক ভোগান্তি মুখে পড়তে হয়। রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন জীর্ণ স্লিপার, লাইন ও লাইনে পাথর না থাকায় যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তবে রেলওয়ে লালমনিরহাটের বিভাগীয় প্রকৌশলী জানিয়েছেন, ট্রেনের বগি লাইনচ্যুতি হচ্ছে লাইনের কারণে নয় বগি বা কোচের কারণে।
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে বগুড়া-লালমনিরহাটে রেললাইন রয়েছে ১২৭ কিলোমিটার লাইন। আর বগুড়া সার্কেল বা সেকশনে বগুড়া-বোনারপড়া পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে ৮৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে সান্তাহার থেকে বগুড়া এলাকা পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার এবং বোনারপাড়ায় ১২ কিলোমিটার। সূত্র জানায়, কেবল বগুড়া সেকশনের মধ্যেই স্টেশন রয়েছে ১৪টি এর মধ্যে ১১টিতে লুপ লাইন রয়েছে। ট্রেন ক্রসিংয়ের সময় লুপ লাইন বেশি 
ব্যবহার হয়। প্রতিটি স্টেশনে কমপক্ষে একটি লুপ লাইন আর বগুড়া স্টেশনে রয়েছে পাঁচটি লাইন। তবে অনেক আগেই এখানকার ৩টি লুপ লাইন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পরিত্যক্ত। শুধু একটি লুপ লাইন সচল থাকলেও তারও বেহাল অবস্থায়। রেলস্টেশন সূত্র জানায়, একাধিকবার এর বেহাল অবস্থা তুলে ধরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়েও কোনো লাভ হয়নি।

বগুড়া রেলস্টেশনের লুপ লাইনের বেহাল অবস্থা ও যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট একাধিক চিঠি পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। ওই চিঠিতে বলা হয়, লুপ লাইনে পাথর নেই, অধিকাংশ স্লিপার দেবে গেছে। ব্যালাস্টও নেই। ১নং লুপ লাইন ট্রেন চলাচলে মোটেও উপযোগী নয়। শুধু বগুড়া রেলস্টেশন নয়, অন্য স্টেশনগুলোর লুপ লাইনেরও একই অবস্থা। এক একটি লুপ লাইন প্রায় সাড়ে ৭শ’ মিটার হয়ে থাকে। বগুড়া স্টেশন ছাড়া অন্যগুলোতে একটি কলে লুপ লাইন রয়েছে। প্রতিদিন রেলস্টেশনগুলোতে ৪/৫ বার রেলক্রসিং হয়।

২৫ জুন সকালে বগুড়ার সুখান পুকুর রেলস্টেশনে লোকাল ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে প্রায় তিনটি ট্রেন আটকে পড়ে এবং প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। সর্বশেষ রবিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে সান্তাহার থেকে বোনারপাড়া লোকাল ট্রেন সান্তাহারগামী পদ্মরাগ ট্রেনকে ক্রসিং দিতে ২নং লাইনে ওঠার সময় লাইনচ্যুত হয়। এ সময় পদ্মরাগ ট্রেনটি নাড়ুয়ামালা এলাকায় আটকে পড়ে। সান্তাহার থেকে একটি লাইট ইঞ্জিন গাবতলী স্টেশনে পৌঁছে মূল লাইন (১নং লাইন) ক্লিয়ার করলে রাত প্রায় ১১টা ২০ মিনিটে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয়। 
রেল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে  লুপ লাইনে পাথর নেই। গাবতলী স্টেশনে যেখানে বগি লাইনচ্যুত হয়েছে সেখানে লাইন ঘাসে পরিপূর্ণ, স্লিপার দেবে গেছে এবং স্লিপারও ভাঙা। নেই পাথার। মূল লাইনের অনেক স্থানেও একই অবস্থা। একাধিক সূত্র জানায়, শুধু লুপ লাইন নয়, মূল লাইনেও সমস্যা রয়েছে। পুরাতন এই লাইনে প্রায় দেড় বছর আগে বগুড়া স্টেশনের নিকট প্রায় এক ফুটের বেশি ভেঙে গেলে একটি আন্তঃনগর ট্রেন অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। এ ছাড়া নোচ বাকলিং হওয়ায় আরেকটি দুর্ঘটনাও অল্পের জন্য হয়নি।
সূত্র জানায় রেললাইন মূলত স্লিপারের ওপর থাকে। কংক্রিট ও স্টিলের স্লিপারের সঙ্গে কাঠের স্লিপার ব্যবহার হয়ে থাকে। লুপ লাইনে রয়েছে কাঠের স্লিপার। তবে মূল লাইনের জয়েন্টে নির্দিষ্ট দূরত্বে কাঠের স্লিপার প্রয়োজন। একাধিক সূত্র জানায় এসব স্লিপারের বেশির ভাগই অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর কারণ হিসাবে নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক সূত্র জানিয়েছে, আগে রেলওয়েতে যে ধরনের কাঠের স্লিপার আসত এখন তা আসছে না এবং যেনতেন কাঠের স্লিপার দেওয়া হচ্ছে।

এজন্য এসব স্লিপার আর আগের মতো মানসম্পন্ন হচ্ছে না। রেলওয়ে বগুড়ার প্রকৌশল দপ্তরসহ একাধিক সূত্র জানিয়েছে বগুড়ায় দীর্ঘদিন ধরে জীর্ণ স্লিপার পাল্টানোর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মচারী জানান তাদের কাছে এক বছরের বেশি সময় ধরে কোনো স্লিপার নেই। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৬ মাস আগে চাহিদা দিলেও লাইন বা স্লিপার কোনোটাই তাদের হাতে পৌঁছায়নি। জোড়াতালি দিয়ে তারা কাজ চালাচ্ছেন।

সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হয়ে উঠছে সান্তাহার বোনারপাড়া লাইনে হাজার হাজার স্প্যান্ডেল স্লিপ নেই। এক সূত্র প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি স্প্যান্ডেল ক্লিপ না থাকার বিষয়টি জানালেও বগুড়া সেকশনের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সাইদুর রহমান জানিয়েছেন এর পরিমান ২/৩ হাজারের বেশি নয়। তিনি জানান প্রায় ৬ মাস আগে স্লিপারের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। বগুড়া রেলওয়ের (পথ) এক কর্মকর্তা জানান তাদের ৪/৫ হাজার স্লিপার প্রয়োজন।
এদিকে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত, স্লিপার পাথর না থাকাসহ স্প্যান্ডেল ক্লিপ উধাও হওয়া প্রসঙ্গে রেলওয়ে লালমনিরহাটের বিভাগীয় প্রকৌশলী জানান, তাদের ধারণা ট্রেন বগি লাইনচ্যুত হয়েছে কোচ বা ক্যারেজের কারণে। এখানে লাইনের কোনো বিষয় নেই। লুপ লাইনে স্লিপার ও পাথার না থাকার বিষয়ে জানান এগুলোতে ধারাবাহিক কাজ চলছে। গুরুত্ব অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। স্প্যান্ডেল ক্লিপের বিষয়ে তিনি জানান, স্প্যান্ডেল ক্লিপ না থাকলে লাইন থাকা কিভাবে হাজার হাজার ক্লিপ না থাকর বিষয়টি সঠিক নয়। তিনি জানান, বগুড়াতে স্লিপার না থাকলে অন্যখানে রয়েছে। সেখান থেকে স্লিপার আনা হবে।

×