ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১

রেজিস্ট্রি অফিসে চলে ঘুষের খেলা

সম্পদের পাহাড় সাব-রেজিস্ট্রারের

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল

প্রকাশিত: ০১:০২, ১ জুলাই ২০২৪

সম্পদের পাহাড় সাব-রেজিস্ট্রারের

সাব রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোলের কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পত্তি

সরকারি চাকরি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বরিশাল সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। ঢাকায় এবং বরিশালে তিনটি ফ্ল্যাট, সরকারি খাস জমিতে পাঁচতলা ভবন, নামে-বেনামে ক্রয় করেছেন কোটি কোটি টাকার জমি। সাব-রেজিস্ট্রারের এত টাকার উৎস খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, রেজিস্ট্রি অফিসে চলে ঘুষের খেলা। অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে ঋণ এবং ব্যবসা সম্পদের উৎস দাবি করেছেন অভিযুক্ত সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। অপরদিকে এ বিষয়ে দ্রুত খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল তার চাকরির ৩৪ বছরে গড়েছেন ঢাকায় দুইটি ফ্ল্যাট, নগরীর পোর্ট রোড এলাকার সরকারি খাস জমিতে করেছেন পাঁচতলা ভবন। নগরীর হাসপাতাল রোড এলাকার অগ্রণী হাউজিং লিমিটেডের ড্রিম প্যালেসে কিনেছেন কোটি টাকার ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নং-৩-অ)। এছাড়া সদর উপজেলার সায়েস্তাবাদে ১ একর ২৫ শতক জমিতে স্ত্রীর নামে করেছেন সোনার বাংলা মৎস্য খামার ও এগ্রো ফার্ম। শহরতলীর কাগাসুরা মুকুন্দপট্টি রাস্তার দুই পাশে ৮০ শতক জমি কিনে করেছেন সুগন্ধা এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ। একই এলাকার কাগাসুরা বাজারের পাশে এক শ’ শতক জমি কিনে তার ওপর করেছেন মালটা বাগান। নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ক্রয় করেছেন ১২ শতকের প্লট ও লাকুটিয়া বাজার এলাকায় ২০ শতক জমির ওপর করেছেন সুগন্ধা পোল্ট্রি খামার। এছাড়া তালতলী বাজারে স্ত্রীর নামে রয়েছে ইট, বালু ও রড সিমেন্টের দোকান। নিজের, স্ত্রীর ও ছেলের নামে রয়েছে প্রচুর সম্পদ।
সূত্রমতে, চাকরির সুবাদে যখন যেখানে বদলি হয়েছেন সেখানেই সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল ক্রয় করেছেন জমি ও ফ্ল্যাট। তার সব সম্পত্তির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকারও বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাই একজন সাব-রেজিস্ট্রারের এত সম্পত্তির উৎস খতিয়ে দেখার দাবি করেছেন সচেতন বরিশালবাসী।
সদর উপজেলার সায়েস্তাবাদ এলাকার বাসিন্দা সাহাবুদ্দিন মিয়া জানান, একজন সাব-রেজিস্ট্রার হয়ে এত বিশালাকার জমি কিভাবে ক্রয় করেছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে এখন সবকিছুই সম্ভব, আর যা কিছু অবৈধ উপায়ে হচ্ছে তা কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাই করছেন। এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কারণে সরকারকে অনেক সময় সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
কাগাসুরা বাজার এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোলের মালটা বাগান দেখভালের জন্য একজন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে সাব-রেজিস্ট্রার এখানে এসে ঘুরে যান। এছাড়াও এই এলাকায় তার আরও কয়েকটি বিশালাকার প্লট রয়েছে। সূত্রমতে, এর আগে কুমিল্লা, চাঁদপুর ও গাজীপুরে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে ছিলেন অসীম কল্লোল। ৪০ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে তার বেতন ৭০ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই টাকার মধ্যে বিলাসী জীবন কাটিয়ে কিভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন তার অনুসন্ধান শুরুর পর সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোলের ছেলে পরিচয়ে সাংবাদিকদের ফোন দিয়ে দেখা করে চা খাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেছেন।
তবে সকল প্রলোভনের ঊর্ধ্বে এসে সংবাদকর্মীদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোলের এই সম্পদ অর্জনে বরিশাল সদর ভূমি অফিসকে ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের কাছে দীর্ঘদিন অসহায় অবস্থায় রয়েছে ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা বহু সাধারণ মানুষ। 
জমির মালিকদের সঙ্গে ওই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি রয়েছেন শতাধিক দলিল লেখক। টাকা ছাড়া একটি দলিলও সম্পন্ন হয় না। এমন পরিস্থিতিতে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে ভূমি অফিস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জমির মালিক জানান, ঈদের পরে নগরীর ৭৩ শতক একটি জমির আপোস বণ্টননামা সম্পাদনের জন্য যান সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে। এক লেখকের মাধ্যমে দলিলটি অসীম কল্লোলের সামনে দেওয়া হলে তিনি জানান, আপোস বণ্টননামা দলিল করাতে হলে ছয় শতাংশ উৎস কর দিতে হবে। অথচ আপোস বণ্টননামায় কোনো উৎস কর সরকারের ধার্য করা নেই। পরবর্তীতে সরাসরি দুই লাখ টাকা ঘুষ হিসেবে দাবি করা হয়। এরপর মোহরার সুশীল চন্দ্র মিস্ত্রি বিষয়টির মধ্যস্থতা করেন এবং সমাধান হয় এক লাখ টাকার বিনিময়ে। এভাবেই ঘুষের টাকার মাধ্যমে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য রয়েছে টয়োটা ব্র্যান্ডের দামি গাড়ি যার নাম্বার (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৬৪৮১)। 
অভিযোগকারী ভুক্তভোগীদের দাবি, অসীম কল্লোলের ঘুষ গ্রহণ ওপেন সিক্রেট। তবে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না।
বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, সাব-রেজিস্ট্রার হয়ে যদি অবৈধভাবে কোনো কিছু করে থাকেন তাহলে তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি সরকারি জমিতে পাঁচতলা ভবনের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। দুদকের বরিশাল কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সার্বিক বিষয়ে বরিশাল সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এত সম্পত্তি আমার নেই। তবে বরিশালে একটি, ঢাকায় দুইটি ফ্ল্যাটসহ পাঁচতলা ভবন আছে। এছাড়া কিছু জায়গা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এসব সম্পত্তি ইনকাম ট্যাক্সের ফাইলে আছে। ফাইলের বাহিরে এক শতক জমিও নেই। সরকারকে প্রতিবছর এসব সম্পত্তির ট্যাক্স দেওয়া হয়। তাছাড়া এসব নিয়ে ২-৩ বার দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে ডাকা হয়েছিল। তারা সম্পদের বিবরণী খতিয়ে দেখেছে।

×