ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

ফয়সাল ও মোস্তাফিজের জবানবন্দি

পাহাড়ে পুলিশকেই জিজ্ঞাসা করে কোথায় থাকব?

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২৯ জুন ২০২৪

পাহাড়ে পুলিশকেই জিজ্ঞাসা করে কোথায় থাকব?

আনোয়ারুল আজিম আনার

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার দুই আসামি ফয়সাল ও মোস্তাফিজ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পাহাড়ের মন্দিরে যেভাবে পরিচয় গোপন করে দীর্ঘ ২৩ দিন আত্মগোপন করেছিল, সেই নেপথ্য কাহিনী বের হয়ে এসেছে তদন্তে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রথমে ১ হাজার ২শ’ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দিরে আত্মগোপনের চেষ্টা করেছিল তারা।

কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পুণ্যার্থীদের রাত্রিযাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেখানে থাকতে ব্যর্থ হয়ে পাহারারত পুলিশের কাছেই জানতে চায়, আমরা পুণ্যার্থী, রাতে থাকব কোথায়? পাহাড়ের উঁচুতে পাহারারত পুলিশ জানায়, চট্টগ্রামের সীতাকু- পাহাড়ের নিচে কয়েকটি পাহাড় পরে একটি কালীমন্দির আছে, যেখানে পুরোহিত পুণ্যার্থীদের থাকতে দেয়, সেখানে চলে যাও। পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে নেমে তারা কয়েকটি পাহাড় ঘুরে সেই কালীমন্দিরের সন্ধান পায়, যেখানে পাতাল কালীমন্দিরের পুরোহিত পুণ্যার্থীদের থাকতে দেয়।

ফয়সাল ও মোস্তাফিজ নাম পরিবর্তন করে নিজেদের শিমুল রায় ও পলাশ রায় পরিচয় দিয়ে মন্দিরের অন্যদের সঙ্গে মিশে যায়। তারা সকালে উঠে বাজারে যায়, কেনাকাটা করে, তরিতরকারি কাটাকুটি সারে, রান্নাবান্না করা থেকে পুণ্যার্থীদের সেবা প্রদান করতে থাকে, যাতে কারও কোনো সন্দেহ না হয়। সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে দীর্ঘ ২৩ দিন পার করে কালী মার ভক্ত সেজে নির্ভার হয়েছিল, তখনই গ্রেপ্তার হলো, পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পারল না তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে ছয়দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে যেভাবে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করেছিল, সেই নেপথ্য কাহিনীর বর্ণনা তুলে ধরেছে জবানবন্দিতে।

এ খবর জানা গেছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এমপি আনার হত্যাকারী ফয়সাল ও মোস্তাফিজ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ট্রাকচালক ছিল। চট্রগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ছিল তাদের আগে থেকে কম-বেশি জানাশোনা। এমপি আনার হত্যার পর ঢাকায় চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল ও মোস্তাফিজÑ এই তিনজন গ্রেপ্তারের পর অন্য আসামিরা যে যার মতো আত্মগোপনে চলে যায়।

ভারতের কলকাতা সঞ্জীবা গার্ডেনে এমপি আনারকে হত্যার মিশনে যে সাতজন অংশ নিয়েছিল তার মধ্যে সর্বশেষ ফয়সাল ও মোস্তাফিজ  গ্রেপ্তার হয়েছে।। চট্টগ্রামের সীতাকু- এলাকার শ্রী শ্রী পাতাল কালীমন্দির থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ফয়সাল আলী সাহাজী ও মোস্তাফিজুর রহমান ফকির প্রথমে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ ধামে গিয়েছিল। সেখানে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাছে পুণ্যার্থী পরিচয় দিয়ে তারা কোথায় রাত্রিযাপন করতে পারবেÑ এমন তথ্য জানতে চেয়ে পাতাল কালীমন্দিরের সন্ধান পায় তারা। এরপর চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে নেমে কালীমন্দিরে এসে দীর্ঘ ২৩ দিন আত্মগোপন করে থাকে তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সীতাকু-ে ১২০০ ফুট ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রনাথের মন্দির। চন্দ্রনাথ ধামকে ঘিরে প্রচলিত আছে সনাতন ধর্মীয়দের জায়গাগুলো হয়ে উঠেছে শক্তিপীঠ, সনাতন ধর্মীয় মানুষের তীর্থস্থান। চন্দ্রনাথ মন্দির তেমনই একটি জায়গাÑ তীর্থস্থান। মন্দিরটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তবে ১২০০ ফুট উঁচু এই চূড়ায় পৌঁছানো বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। পাহাড়ের গোড়া অবধি পৌঁছাতেই শরীর ঘেমে ওঠে। চূড়ায় যাওয়ার দুটি পথ।

হাতের ডান দিকের সিঁড়ি উঠে গেছে একেবারে চূড়া অবধি। বাঁ দিকের পথ বেছে নিলে ডেঙাতে হবে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা। এই ধরনের প্রতিকূল রাস্তার পরিবেশ অতিক্রম করে পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিতে চেয়েছিল মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পুলিশের একটি ফাঁড়ি আছে। যেখানে আট-নয়জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করে। ওই এলাকায় সিসি ক্যামেরাও বসানো আছে। তবে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মন্দিরে রাতে অবস্থান করার সুযোগ নেই।

গত ১৯ মের পর ফয়সাল ও মোস্তফিজ ঢাকা থেকে পালিয়ে যায়। পাতাল কালীমন্দিরে আত্মগোপন করে গত ২৩ মে থেকে। টানা ২৩ দিন সেখানে তারা আত্মগোপনে থাকে। তবে ঈদ উদ্যাপন করতে কয়েকদিনের জন্য মন্দির ছেড়ে যায় মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। ঈদ হয় ১৭ জুন। ঈদের আগে ১৫ জুন পর্যন্ত মন্দিরে র্ছিল মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। এতদিন হিন্দু পরিচয়ে মন্দিরে আত্মগোপন করলেও ঈদের আগে ১৫ জুন তারা মন্দির থেকে চলে যায় খাগড়াছড়ির রামগড়ে। সেখানে ফয়সালের এক বন্ধু রয়েছে। তার বাড়িতে ঈদ করে। ঈদ শেষে তারা আবার মন্দিরে ফিরে আসে। তারা ফিরে আসার পর তাদের অবস্থান শনাক্ত হয়ে গেলে গ্রেপ্তার হয় ফয়সাল ও মোস্তাফিজ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে প্রলুব্ধ করে ভারতের কলকাতার গোপালের বাসা থেকে বের করার পর তাকে প্রথমে গ্রহণ করে ফয়সাল। তারা একসঙ্গে একটি জায়গায় যাওয়ার পর গাড়ি পরিবর্তন করে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল মূল কিলার আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। গাড়ি পরিবর্তন করে এমপি আনার, শিমুল ও ফয়সাল তিনজন এক গাড়িতে কলকাতা নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন্সে পৌঁছায়।

ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে দরজা খুলে এমপি আনারকে অভ্যর্থনা জানায় শিলাস্তিÍ রহমান। এমপিকে স্বাগত জানিয়ে শিলাস্তি চলে যায় ত্রিপেক্স ফ্ল্যাটের ওপরতলায়। আর শিমুলসহ অন্যরা এমপি আনারকে নিয়ে যায় ওই ফ্ল্যাটের কর্নারের একটি কক্ষে। কক্ষে নেওয়ার পর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তা বুঝতে পেরে ওই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এমপি আনার। কিন্তু শিমুল ভূঁইয়াসহ অন্যরা বাধা দেয়।

আনারকে পেছন থেকে গলায় ধরে নাকে-মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম মেশানো রুমাল দিয়ে চেপে ধরে ফয়সাল। কিছু সময় ধস্তাধস্তির পর নিস্তেজ হয়ে পড়েন এমপি আনার। এরপর আনারকে বিবস্ত্র করে একটি চেয়ারে বেঁধে ফেলে আসামিরা। একপর্যায়ে তাকে হত্যা করা হয় এবং হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে মরদেহ গুম করে ফেলে, যে কারণে এখনো পর্যন্ত এমপি আনারের লাশ পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এমপি আনার হত্যার মতো হাই-প্রোফাইল মামলার আসামিরা দেশের যে কোনো জায়গায় আত্মগোপনে থাকতে পারলেও চন্দ্রনাথ পাহাড়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের সামনে দিয়ে দুই পলাতক আসামি চলে যাওয়ার ঘটনাটি খুবই নাটক-সিনেমার ডিটেকটিভ গল্পের মতো বিস্ময়কর। ফয়সাল ও মোস্তাফিজ সর্বহারা চরমপন্থি দলের সদস্য হিসেবে যেমন দুর্ধর্ষ, তেমনি ছদ্মবেশ ধারণ করতেও পারদর্শী তারা তা প্রমাণ করেছে।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মন্দির, তীর্থস্থানে অগণিত ধর্মপ্রাণ মানুষের আগমন-নির্গমনের কারণে কারও পরিচয় তাৎক্ষণিক নির্ণয় করা কঠিনই বটে। চন্দ্রনাথ পাহাড় এলাকায় অনেক মন্দির আছে, যেখানে অনেক পুণ্যার্থী ও সাধারণ মানুষ আসে। তাদের মধ্যে কেউ আসামি ছিল কি না, তা আমাদের বোঝার উপায় নেই। আর এখানে কোনো আসামি পাহাড়ে আত্মগোপন করতে পারে, এই ধারণা করা যাবে না- এমন সুযোগ নিয়েছে মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। 
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, পাহাড়ি এলাকা থেকে ফয়সাল ও মোস্তাাফিজকে গ্রেপ্তারের ফলে একে একে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সাতজনের সবাই গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে এ হত্যাকা-ের ফলে কারা আর্থিক, রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, হত্যার সুনির্দিষ্ট মোটিভ কি- সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না ডিবি পুলিশ। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা ঘটনার খবর যখন আসে, তখনই আমরা কিন্তু মাস্টারমাইন্ড শিমুল ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করি। এরপর তানভীর ও শিলাস্তিকে গ্রেপ্তার করি।

তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। এরপর আমরা নিজেরা কলকাতায় গিয়ে সঞ্জীবা গার্ডেন পরিদর্শন করি। এই হত্যাকাণ্ডে আরও জড়িত দুজনের নাম জানতে পারি। তারা ফয়সাল ভূঁইয়া ও মোস্তাফিজুর রহমান। তারা আত্মগোপনের জন্য ফটিকছড়ি ও সীতাকু-ের মাঝখানে পাতাল কালীমন্দিরে লাল ধূতি পরে অবস্থান করছিল। সেখানে তারা হিন্দু পরিচয়ে পাতাল কালীমন্দিরে লুকিয়েও বাঁচতে পারেনি।

×