ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১

নার্সারির গ্রাম বাসুদেবপুর

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ০১:০৮, ২৮ জুন ২০২৪

নার্সারির গ্রাম বাসুদেবপুর

মণিরামপুরের বাসুদেবপুরে একটি নার্সারি বাগান

যশোরের নার্সারির গ্রাম বাসুদেবপুর থেকে বছরে প্রায় এক কোটি গাছের চারা ছড়িয়ে যায় সারাদেশে। এই গ্রামের ঘরে ঘরেই নার্সারি। ছোট-বড় প্রায় চারশ’ নার্সারিতে এমন কোনো চারা নেই যা পাওয়া যায় না। বছরজুড়ে সারাদেশে ট্রাকভর্তি করে চারা সরবরাহ করেন নার্সারি মালিকরা। এতে একদিকে যেমন গ্রামজুড়ে সবাই স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি এই বিপুল পরিমাণ চারা উৎপাদন করে ভূমিকা রাখছেন পরিবেশ রক্ষায়।

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের একটি গ্রাম বাসুদেবপুর। যশোর শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত গ্রামটিতে প্রায় ৫শ’ পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে চারশ’ বাড়িতেই আছে নার্সারি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক নার্সারি শতাধিক। আর বাসুদেবপুর বাজারে শতাধিক ছোট-বড় চারা বিক্রির দোকান রয়েছে। গ্রামের চারভাগের তিনভাগ বাসিন্দাই নার্সারির সঙ্গে জড়িত। গ্রামের যেদিকেই চোখ যায় শুধুই নার্সারি আর গাছের চারা।

আম, কাঁঠাল, পেয়ারা থেকে শুরু করে দেশী সব ধরনের ফল ছাড়িয়ে আপেল, কমলালেবু, আঙুর, মাল্টা, বিদেশী পার্সিমন, ডরিয়ান, রামবুটান, পিনাক বাটার, কিউই, শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দনসহ বিভিন্ন ফলদ ও ভেষজ গাছের চারা রয়েছে এই নার্সারিগুলোতে। বাসুদেবপুরে নার্সারির গোড়াপত্তন করেন মোহাম্মদ আলী (৭৩)। মণিরামপুর উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় তিনি ‘নার্সারির গুরু’ হিসেবেই পরিচিত। বাজারের পাশে ‘পুরাতন নার্সারি’ নামে তার প্রতিষ্ঠানটি এখন ছেলেরা দেখাশোনা করেন। শুরুর কথা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ আলী ফিরে যান প্রায় ৬০ বছর আগের অতীতে। তখন দেশ স্বাধীন হয়নি।

বাবা ওলিউল্লাহ মুন্সীর সঙ্গে ঝিকরগাছা বাজারে যেতেন লিচুর কলমের চারা নিয়ে। এক, দু’ আনা দরে বিক্রি করতেন। সে সময় নৌকায় করে বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা ঝিকরগাছায় আসতেন আমড়া, তেজপাতা, পেয়ারাসহ বিভিন্ন গাছের চারা নিয়ে। তাদের চারা পর্যবেক্ষণ ও আলাপ আলোচনা করে ধীরে ধীরে শেখার চেষ্টা করেন অন্য গাছের চারা তৈরির পদ্ধতি। লিচুর পরে সুপারির চারা করতেন। পরে জামরুল, তেজপাতা, সফেদা, আম, কুল, পেয়ারা ইত্যাদির চারা ও কলম তৈরি শুরু করেন।

এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৫৬ বছর ধরে তিনি নার্সারিতে চারা উৎপাদন করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারাদেশে। মোহাম্মদ আলী আরও জানান, তার বাবা নার্সারির ব্যবসা শুরু করলেও প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন তিনি। এখন এই গ্রামে অত্যন্ত ভালো মানের চারা তৈরি হয়। অন্য এলাকার তুলনায় দামেও কম। যে কারণে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ সারাদেশের পাইকারি বিক্রেতা ও কৃষি উদ্যোক্তারা এখান থেকে চারা কিনে নিয়ে যান।

মোহাম্মদ আলী চারা তৈরি ও ব্যবসা করে ২৫ বিঘা জমি কিনেছেন। পাকা বসতবাড়ি বানিয়েছেন। এখন ‘পুরাতন নার্সারি’র একাংশ দেখাশোনা করেন মোহাম্মদ আলীর ছেলে আনারুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাবার হাত ধরেই তিনি নার্সারি ব্যবসায় এসেছেন। তাদের নার্সারি থেকেই বছরে কয়েক লাখ গাছের চারা সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। তাদের দেখাদেখি গ্রামের ঘরে ঘরে এখন নার্সারি। সারাবছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা গাছের চারা সরবরাহ করেন।

আকাশ নার্সারির স্বত্বাধিকারী শাহজাহান কবীর জানান, বাবার হাত থেকে ১৯ বছর আগে তিনি নার্সারির কাজে হাত দেন। তিনি বলেন, তার নার্সারিতে দশজন শ্রমিক কাজ করে। নার্সারিতে তিনি আম, আমড়া, পেয়ারা, কমলালেবু, মাল্টা, মিষ্টি তেঁতুল, জলপাইসহ ফলদ, বনজ ও ঔষধি বিভিন্ন গাছের চারা উৎপাদন করেন। বিভিন্ন এলাকার পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা গাড়িভরে এসব চারা কিনে নিয়ে যায়। বছরে তিনি প্রায় ৫০ হাজার চারা উৎপাদন ও বিক্রি করে থাকেন।

নার্সারি শ্রমিকের কাজ করা ভোলানাথ সরকার ও শহিদুল ইসলাম মনু জানান, গ্রামের ঘরে ঘরে নার্সারি হওয়ার পর এখন আর কাজের অভাব হয় না। গ্রামের শ্রমজীবী অধিকাংশ মানুষ নার্সারিতে কাজ করেন এবং যে বেতন পান তাতে সংসার চলে যায়।

গ্রামে নার্সারির প্রসারে উদ্বুদ্ধ হয়ে জামাল হোসেন বাড়ির উঠানে ও ছাদে নার্সারি করেছেন তিন বছর হলো। এ ব্যাপারে মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার বলেন, রোহিতা ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে প্রায় প্রতিটি ঘরেই নার্সারি রয়েছে। তারা অনেক ধরনের গাছের চারা উৎপাদন এবং বছরজুড়ে সারাদেশে সরবরাহ করে থাকেন। 
সাজেদ রহমান, যশোর

×