ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১

থোকায় থোকায় রসালো আঙ্গুর

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: ০১:০৪, ২৮ জুন ২০২৪

থোকায় থোকায় রসালো আঙ্গুর

বরমী ইউনিয়নের সাতখামাইর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামে চাষ করা হচ্ছে আঙ্গুর

সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে রসালো আঙ্গুর। সুতা ও বাঁশের মাচায় ঝুলে থাকা মিষ্টি এই রসালো ফলের পরিচর্যায় ব্যস্ত যুবক সবুজ। বিদেশি ফল আঙ্গুর দেশে চাষ করলে টক হয় এমন ধারণাকে বদলে দিতে ইউটিউব দেখে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরের যোগীহুদা গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদের কাছ থেকে আঙ্গুরের চারা সংগ্রহ করে আবাদ শুরু করেন তিনি। এ নিয়ে রঙ্গিন স্বপ্ন বুনছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের সাতখামাইর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা সবুজ।

সবুজের ফল বাগানের মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙ্গুর। আঙ্গুরের লতায় পেঁচানো গেট সাদৃশ মাচার ভেতর দিয়েই প্রবেশ করতে হয় তার ফল বাগানে। গাজীপুরের লাল মাটিতে আঙ্গুর আবাদ করে ফলিয়ে সফলতা পাওয়া যায় তা প্রমাণ করলেন শ্রীপুরের যুবক সবুজ। তার ফল বাগানে মাচা তৈরি করে তিনি সুপার সনিকা জাতের আঙ্গুর চাষ শুরু করেন। প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে প্রায় বছর খানেক আগে ২৫টি আঙ্গুর গাছ লাগালেও ২১টি গাছে ফলন আসছে।

গাছের একেকটি থোকায় ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম আঙ্গুর ঝুলে আছে। তার বাগানে আঙ্গুরের আকার এবং ফলন ভালো হওয়ায় আশপাশের এলাকা থেকে কৃষকেরা আঙ্গুর চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তার বাগানের আঙ্গুর বিদেশ থেকে আমদানিকৃত আঙ্গুরের তুলনায় বেশি রসালো মিষ্টি ও সুস্বাদু হবে বলে তিনি আশা করছেন। শখের বসে চাষ করে সফল হলে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের পরিকল্পনা রয়েছে তার। 
ঢাকার বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন পাশের টেংরা গ্রামের মনিরুজ্জামান। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে তিনি সবুজের আঙ্গুর বাগান দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন দেশের মাটিতে এত সুন্দর বিদেশি ফল! একটি খেয়ে বলেন এই আঙ্গুর অনেক মিষ্টি হবে। 
শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিক আকন্দ আঙ্গুর বাগান দেখতে এসছেন। তিনি বলেন, যুবক সবুজ তার ফল বাগানে যেসব ফলের চাষ করেছে সবগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ। এর আগে সে কমলা চাষ করে এলাকায় সারা ফেলে দিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সে পারে এটা দেখিয়েছে। তার এ সফলতা অন্যান্য যুবক ও কৃষকদের প্রেরনা দিবে। বাংলাদেশের যুবকেরাও বিদেশি ফল এদেশের মাটিতে ফলাতে পারে সবুজ তার প্রমাণ। 
সরেজমিনে সাতখামাইর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল এরিয়া নিয়ে কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাগানে প্রবেশ করতেই নজরে আসে সুতা দিয়ে মাচা তৈরি করে আঙ্গুর চাষ করেছেন। তার ফল বাগানে ঢুকতেই দেখা মেলে থোকাই থোকাই ঝুলে আছে রসালো আঙ্গুর। বাগানের সমস্ত কাজ খুটে খুটে দেখছেন সবুজ নিজে। আঙ্গুরের পাশাপাশি মিশ্র ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। তাঁর বাগানে আছে কমলা, কুল, পেয়ারা, পেপে, চায়না কমলা, কলা, করমচা ও আমের গাছ। তার বাগান দেখতে প্রতিদিন আসছে চাষি ও দর্শনার্থী। 
বাগানের কাজে সাহায্য করা সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশ থেকে অনেক মানুষ বিদেশে যায় ফলের বাগান বা আঙ্গুর বাগানে কাজ করতে। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে আঙ্গুরের বাগানে কাজ করব। এই আঙ্গুর খেতে খুব রসালো এবং মিষ্টি হবে মনে হচ্ছে। 
আঙ্গুর চাষি সবুজ মিয়া বলেন, ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার যোগীহুদা গ্রামের কৃষকের কাছ থেকে আঙ্গুর চারা সংগ্রহ করি। রোপনের সাত মাসের মাথায় ফলন পাওয়ার কথা থাকলেও তার বাগানে আঙ্গুরের ফলন আসে ১০ মাসে। পরিচর্যায় ঘাটতির কারণে ফলন আসতে তিন মাস দেরি হয়েছে বলে দাবি তার। আমার মতো আরো উদ্যোক্তা আঙ্গুর চাষে এগিয়ে আসলে বাইরে থেকে দেশে লাখ লাখ টন আঙ্গুর আনতে হবে না। এই আঙ্গুর চাষ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে পারব।

পাশাপাশি একদিকে যেমন আমাদের দেশ উন্নত হবে, সামনের দিয়ে এগিয়ে যাবে, অপরদিকে আমাদের আর্থিক অবস্থাও অনেক উন্নত হবে। যদি কেউ আমার বাগানে আসতে চান অবশ্যই আসবেন, আঙ্গুর খেয়ে যাবেন। এখনো গাছে আঙ্গুর আছে। নিজেকে সফল উদ্যোক্তা বলে মনে হচ্ছে। কৃষি বিভাগ ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাণিজ্যিকভাবে আঙ্গুর চাষে সফল হওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

আঙ্গুর চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য ও আষাঢ় মাসে আঙ্গুরের চারা রোপণ করলে প্রথম বছরেই ফল পাওয়া যাবে। আর যদি আরো দেরিতে লাগাই তাহলে ফল কম আসবে। একেবারেই সহজ পদ্ধতিতে আঙ্গুর চাষ করা যায়। জমিতে ৭-৮ ফুট উচ্চতার পিলার লাগবে। চারা লাগনোর সময় খেয়াল রাখতে হবে এক লাইন থেকে আরেক লাইনের ৯ ফুট দূরত্ব এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৬ ফুট রাখতে হবে। এভাবে রোপণ করলে ফলন ভালো হবে। চারা লাগানোর আগে জৈব সার, টিএসপি ও জিপ-সার দিয়ে যেখানে চারা লাগাবে সেখানে ভালোভাবে খুড়ে সার দিতে হবে। চারা লাগানো পর ১০-১২ দিন ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। একবার ফল আসা শুরু করলে নিয়মিত পরিচর্যায় অনেক দিন যাবত আঙ্গুর পাওয়া সম্ভব। 
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুমাইয়া সুলতানা বন্যা বলেন, আঙ্গুর একটি উচ্চমূল্য ফল। আমাদের দেশে আঙ্গুরের চাষ নেই বললেই চলে। শ্রীপুরের মাটি আঙ্গুর চাষের জন্য উপযুক্ত। সাতখামাইর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামের যুবক সবুজ প্রাথমিকভাবে আঙ্গুর চাষ করে দেখিয়েছে। আমরা সার ব্যবস্থাপনা ও ওষুধ প্রয়োগের ব্যাপারে কৃষি বিভাগ সবসময় তার পাশে থেকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। যদি আঙ্গুরের মান ভালো হয় তাহলে কৃষকদের নিয়ে আঙ্গুর চাষে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব। সে লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। 
মোস্তফা কামাল প্রধান, শ্রীপুর, গাজীপুর

×