ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

শীর্ষে যশোর

আষাঢ়েও স্বস্তিকাড়া গরম

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ০১:১৩, ২১ জুন ২০২৪

আষাঢ়েও স্বস্তিকাড়া গরম

বসন্তকালের শীতল আবহাওয়াতেও প্রতিদিন উষ্ণতা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে থাকে

বসন্তকালের শীতল আবহাওয়াতেও প্রতিদিন উষ্ণতা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পহেলা মার্চ থেকে খুব দ্রুততার সঙ্গে গ্রীষ্মের উষ্ণতা শুরু হয়ে যায়। চলতি বছর দীর্ঘতম তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে। আমাদের দেশের বর্ষা ঋতুর বৈশিষ্ট্য হলো পানি, শরতের বৈশিষ্ট্য মাটি, বায়ু এবং গ্রীষ্মকাল মানেই যেন আগুনের হলকা। যদিও বর্ষাকাল শুরু হয় মধ্য জুন থেকে।

কিন্তু অল্প কিছু বৃষ্টিপাত এই সময় হয়ে থাকে। আসলে এপ্রিল-মে মাসে প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি হয়। এই সময় শিলাপাত ঘটে। মুঠো সাইজের এসব শিলা পড়ে মানুষের ফসলেরও ক্ষতি হয়। বিশেষ করে বোরো ধানের। মার্চ নাগাদ মাটি ধূসর হয়ে ওঠে এবং এরপর আস্তে আস্তে সাদা বর্ণ ধারণ শুরু হয়ে যায়। নদীতে যান চলাচলের পথ অগভীর হয়ে পড়ে।

এ বছর গরম বেশি পড়ায় দেশের সবখানে গরম নিয়ে আলাপ শুরু হয়। যেমন এ বছর  বৈশাখ আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেল ‘হিট ওয়েভ’ বা তাপপ্রবাহ, যা সারা বাংলাদেশে বয়ে গেছে। ফ্যান ছাড়লে গরম বাতাস টের পাওয়া যায়। জলবায়ুর পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে। সাধারণত একদিকে ঝুঁকতে থাকে। যেমনÑ বর্তমানে পৃথিবীর জলবায়ু ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে। বায়ুম-লে কিছু গ্রিন হাউস গ্যাস থাকা স্বাভাবিক। পৃথিবীতে প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য উষ্ণতা প্রয়োজন আছে। কিন্তু অত্যধিক গ্রিন হাউস গ্যাস অতিরিক্ত উষ্ণতা সৃষ্টি করে।

কয়লা ও তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, গাছপালা কেটে ফেলা একটি বড় সমস্যা। গাছ না থাকলে ছায়া এবং বাষ্পের পরিমাণ কমে উচ্চ তাপমাত্রা নিয়ে আসতে পারে। প্রতিটি শহরেই কিছু রাস্তা আছে- যে রাস্তার পাশে বা আইল্যান্ডে গাছ আছে, আর যে রাস্তায় গাছ নেই, এমন রাস্তা দিয়ে একদিন হাঁটলে স্পষ্ট পার্থক্য বোঝা যাবে। গরমে শহুরে ফুটপাতের তুলনায় একটি ঘাসভরা মেঠোপথে হাঁটা সহজ। শ্বাস নেওয়া স্বস্তির। মানুষ গরম অনুভব করে ত্বক দিয়ে। গাছপালাযুক্ত এলাকায় থাকলে ত্বকে শীতল বোধ হবে। আর শ্বাস-প্রশ্বাসও গরম অনুভবের কারণ! গরম বায়ুতে শ্বাস নিলে বোঝা যায়।
শহরে অনেক কম গাছপালা দেখা যায়। ফুটপাত, রাস্তা আর উঁচু ভবন শহরের স্বাভাবিক দৃশ্য। এগুলো ইট, সিমেন্ট, কাচ, ইস্পাতের মতো উপকরণ দিয়ে তৈরি। সাধারণত খুব গাঢ় রঙের হয়। কালো, বাদামি আর ধূসর রং দেখা যায়। কালো বস্তু আলোক শক্তির সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে তাপে রূপান্তর করে। বিপরীতে সাদা বস্তু আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। আলো তাপে রূপান্তর হয় না এবং সাদা বস্তুর তাপমাত্রা তেমন বাড়ে না। শহরের রাস্তা কালো পিচের তৈরি। ছাদগুলো ধূসর আবরণ দেওয়া।

উত্তাপের বড় অংশ আসে এসব স্থাপনা থেকে। বিল্ডিংয়ের উপকরণ শহর এলাকায় তাপ আটকানোর আরেকটি কারণ। অনেক আধুনিক বিল্ডিং উপকরণের কারণে পৃষ্ঠতল থেকে পানি ইট বা সিমেন্টের প্যাঁচে পড়ে ওপর থেকেই বাষ্প হয়ে যায়। ভূ-পৃষ্ঠে প্রবাহিত হতে পারে না। গ্রামে উদ্ভিদের মাধ্যমে যেমন এলাকা ঠা-া হয়, শহরে বড় জলাধার তৈরি আর মাটি দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে তাপমাত্রা কমতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা, জলাশয়, জলাভূমি, বনভূমির কাছাকাছি বাস করলে উত্তাপ থেকে বাঁচা যাবে।

সম্ভব না হলে বেশি করে গাছ লাগানো, গাছ না কাটা আর জলাভূমি ভরাট না করাই তপ্ত পৃথিবীতে বাঁচার উপায় বলে বিবেচিত হবে। জেমস জে. নোভাক লিখেছেন, ‘বর্ষাকালে জোরেশোরে বৃষ্টি নামার আগে ঠিকাদার কাজ শেষ করার জন্য পিচ গলানোর চুল্লির পাশে (সড়ক) নির্মাণকর্মীরা যখন কাজ করে তখন ওদের গা দিয়ে ঘামের ধারা ছোট ছোট স্রোতস্বিনীর আকারে যেন দর দর করে বেয়ে পড়তে থাকে। গ্রীষ্মের নিদারুণ তাপে গাঁয়ের মাটির ঘরের দেওয়ালগুলোতে বড় বড় ফাটল দেখা দেয়। আর খেতের চাষি-মজুররা মাথা ঢাকে টোপ বা টোকা দিয়ে।
এদিকে অতিরিক্ত ফসল ফলানোর জন্য নলকূপ দিয়ে পানি ওঠানো হয়। মাত্র কয়েক বছর আগেও গ্রীষ্মে এ ধরনের জমি পতিত থাকত। আর এসব শুকনো, ঊষর খেতে জমা ধুলা ঘূর্ণিবাতাসের টানে নিজেরাই হয়ে ওঠে ঘূর্ণিঝড়। শহরে কাচের আলোর বিচ্ছুরণ, পাকা দালান-কোঠা থেকে প্রতিবর্তিত সূর্যের তাপ, ফুটপাতের দাহ দারুণ শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে ওঠে। অবশেষে তখন শেষ বিকেলে যখন মনে হয় এ ধরণী আর সইতে পারবে না, তখন আকাশ কালো হয়ে আসে। ভয়ংকর বজ্রপাতের সঙ্গে বৃষ্টি নামে।

সন্ধ্যা ধরেই চলতে পারে কিংবা ঘটনা খারাপ হলে আপনাকে শীতল প্রশান্ত করবে কি- ঝড়, বজ্র, বৃষ্টির পাল্লায়ও পড়তে হতে পারে। এই বজ্রবৃষ্টি এমন প্রচ- হতে পারে যে, মনে হতে পারে ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝলসে ওঠা অগ্নি প্রচ- শব্দে আকাশের এপার-ওপার লাল-সাদা দ্যুতির রেখায় ফেড়ে ফেলছে। আর বিদ্যুৎপ্রভায় গোটা আকাশের নিচে বাংলাদেশ উজ্জ্বল ও স্পষ্ট ওঠে, যা এ দেশের আবহাওয়ার একান্ত  বৈশিষ্ট্য।’
এখনকার মতো দেড়শ’ বছর আগেও গরমের সময় যশোরের তাপমাত্রা কেমন ছিল, তা জানতে টমাস ম্যাচেলের দিনলিপি পড়তে হবে। নীলকর টমাস ম্যাচেল ১৮৪০ সাল থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত যশোর এলাকায় ছিলেন। প্রতিদিন তিনি দিনলিপি লিখতেন। ১৮৫০ সালের ৮ এপ্রিল তিনি যশোরের ঝিকরগাছার নীলকুঠিতে এসেছিলেন।

ওই দিন তিনি লিখেছেন, ‘সেজ (নীলকুঠির ইংরেজ) ভাইদের সঙ্গে ঝিকরগাছা গেলাম তাদের তুতোভাই আর পি সেজের সঙ্গে দেখা করতে। আবহাওয়া প্রতিদিনই গরম হয়ে যাচ্ছে। ঘরের মধ্যেই থার্মোমিটারের পারদ ৭৬ থেকে ৯৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি ঘোরাফেরা করছে। সকাল বেলাতেই তা ৭৬ ডিগ্রির বেশি দেখাচ্ছে। ১০টা বাজলেই গরম হাওয়া বইতে শুরু করে দিচ্ছে। দুপুর দুটার সময় ঘরের সবচেয়ে ঠান্ডা অংশে গিয়ে মাপলেও তাপমাত্রা দেখায় ৯৬ ডিগ্রি।

সন্ধের দিকে উত্তর দিক থেকে আসা গরম হাওয়া ক্ষান্ত হয়। তার জায়গায় দক্ষিণের আরামদায়ক মৃদুমন্দ হাওয়া দিতে শুরু করে। গরম যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ে, তখন দেখা দেয় বজ্র বিদ্যুৎ, ঝড় আর অঝোর বৃষ্টি। প্রকৃতি ঠান্ডা হয়, সতেজ আর চনমনে হয়ে ওঠে। গাছপালায় উজ্জ্বল সবুজ রং লাগে। ফুলের সুগন্ধ তীব্রতর হয়। গরমে আধমরা ইউরোপীয়রা ঠান্ডা ভেজা বাতাসে সন্ধেবেলা বাইরে বেরিয়ে পড়ে। তারা আনন্দময় অপার বিস্ময় নিয়ে দেখে এ দেশের প্রকৃতির অন্তহীন প্রাণিজগৎ।

তাদের পায়ের নিচের মাটিতে, তাদের চারপাশের বৃক্ষরাজি, লতাগুল্মের মধ্যে, এমনকি তাদের নিঃশ্বাস নেওয়া বাতাসের মধ্যে কত অগণিত বিচিত্র জীবের সহর্ষ নড়াচড়া। চারদিকে পাখির কলকাকলি আর থেকে থেকে শেয়ালের ডাক। প্রাণের এই বিপুল প্রকাশ কী অসাধারণ! এই পৃথিবী ছোট ছোট প্রাণের স্পন্দনে যেন মুখরিত হয়ে উঠেছে।

অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে গাছেদের গায়ে। সেই অন্ধকারে সংখ্যাতীত জোনাকির দল মিটমিট করে জ্বলছে। টের পাই আমাদের চারপাশ থেকে ছেয়ে আছে অগণিত জগৎ, তাদের সংখ্যা সমুদ্রের বালুকণার মতোই অসীম, অনন্ত তাদের ব্যাপ্তি যা মানুষের ক্ষুদ্র ধারণাশক্তির বাইরে। সেই অসীমের দিকে চাইলে বিস্ময় জাগে, শ্রদ্ধা জাগে।
    সাজেদ রহমান, যশোর

×