আনোয়ারুল আজিম আনার
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি দাবি করেছে, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার পর তার শরীর কিমা তৈরির যন্ত্র দিয়ে কিমা করা হয়। আনার হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে নেপাল থেকে গ্রেপ্তার সিয়াম কলকাতা নিউমার্কেট থেকে ২২০০ রুপিতে যন্ত্রটি কিনেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডিকে উদ্ধৃত করে বুধবার ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গ্রেপ্তার সিয়াম কলকাতার নিউমার্কেটের একটি দোকান থেকে ২২০০ রুপি দিয়ে ওই যন্ত্র কিনেছিল। প্রমাণ লোপাটের জন্যই ওই কিমা করার যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সিআইডির একাংশের দাবি, তবে ওই যন্ত্রে পুরো মাংস কিমা করা যায়নি। তাই তারা লাশটিকে ছোট ছোট টুকরো করে সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দেয়।’
এর আগে কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেন্সের সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে প্রায় পাঁচ কেজি মাংস উদ্ধার করে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। পরে এই মাংস মানুষের কি না তা নিশ্চিত হতে ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য পাঠানো হয়।
এদিকে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য এমপি আজিমের মেয়ে ডরিনের ভারত সফর এখনো অনিশ্চিত। নিহত এমপি আজিমের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ বলেন, ঈদের আগে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্ত কর্মকর্তা ডরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ঈদের পর ভারতে যেতে হবে বলে জানান। তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে তদন্ত কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি। এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ওয়ারি জোনের সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান বলেন, ডরিনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তবে ভারতে যাওয়ার বিষয়ে ডরিন বলতে পারবে।
এদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ভারতে খুন হওয়ার ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর ৮ দিনের রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই ঈদুল আজহার সরকারি ছুটির মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে ৮ দিনের রিমান্ডে এনে ৩ দিনের মাথায় কোনো ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া ছাড়াই কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
নেপথ্যে কী স্বর্ণ চোরাচালান কেন্দ্রিক বিরোধ নাকি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের এই রহস্য উদঘাটনের আগে মিন্টুর কোনো ধরনের জবানবন্দি দেওয়া ছাড়াই কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার কারণে নেপথ্যে অদৃশ্য মহল থেকে কলকাঠি নাড়ছে কি না সেই প্রশ্নটিও সামনে চলে এসেছে। কারণ সাইদুল করিম মিন্টু এমপি আনার খুনের মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে কাজ শেষ হলে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
কিলিং মিশনের সমন্বয়ক আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মে মাসে ভারতে এমপি আনারকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় সাইদুল করিম মিন্টু আর্থিক লেনদেনে জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে, জবানবন্দিতে তদন্তে স্বর্ণ চোরাচালান মাফিয়া ডনের বিষয়টির সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের যুক্ত হওয়ার পর থেকে নেপথ্যে অদৃশ্য প্রভাবশালী মহলের প্রভাব বিস্তার করে হত্যাকা-ের ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ উঠে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র এ খবর জানিয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ১৬ জুন আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে তদন্তকারীরা উল্লেখ করেছেন যে, গত ৫ অথবা ৬ মে হোয়াটসঅ্যাপে আখতারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে আলাপকালে কাজ শেষ হওয়ার পর টাকা দেবেন বলে আশ্বাস দেন সাইদুল করিম মিন্টু। প্রতিবেদনে তদন্তকারীরা উল্লেখ করেন, গত ৫ জুন হত্যা মিশনের সমন্বয়ক আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন যে, মে মাসে ভারতে আনারকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় মিন্টু আর্থিক লেনদেনে জড়িত ছিলেন।
মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করেছে সাইদুল করিম মিন্টুকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিমুল ভূঁইয়া তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেন, মিন্টু গত ৫ অথবা ৬ মে হোয়াটসঅ্যাপে আখতারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে এই হত্যাকা-ের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে কথা বলেছিলেন। বাবুও স্বীকার করেছেন যে, হত্যাকা-ের পর অর্থ লেনদেনের বিষয়ে তিনি শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং দেখা করেছেন। এমনকি বাবু ও শিমুল ভূঁইয়া মোবাইল ফোনে হত্যার ছবি আদান-প্রদান করেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আদালতে এখন পর্যন্ত দুই আসামি ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে সাইদুল করিম মিন্টুর নাম বলেছেন। যে দুজন জবানবন্দিতে মিন্টুর নাম বলেছেন তারা হলেন আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল আহমেদ বাবু। আসামিদের জবানবন্দি ছাড়াও প্রযুক্তিগত তদন্তে এ বিষয়গুলোর বিশদ তথ্য বের করার চেষ্টা চলছে। এমনকি হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকায় দুটি বৈঠক হয়েছিল। সেখানে কারা ছিল, তাও তদন্ত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক শাহীনকে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে আপাতত মনে হলেও তাঁর পেছনেও কেউ রয়েছে কি না, সেই বিষয়টিরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। আখতারুজ্জামান শাহীন বড় ধরনের স্বর্ণ চোরাচালানি। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানি মাফিয়া ডনের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ আছে। মাফিয়া ডনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে দুনিয়াতে কাউকে বাঁচিয়ে রাখে না। মাফিয়া ডন যেভাবে খুন করে লাশ টুকরা টুকরা করে গুম করে ফেলে ঠিক সেভাবেই এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে কি না সেটাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
৮ দিনের রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই কারাগারে ॥ আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যায় খুনিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল করিম মিন্টুর আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। রিমান্ড শেষে সাইদুলকে আদালতে পাঠানোর সময় পুলিশ প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ করা সত্ত্বেও কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। গত ১৬ জুন সাইদুল করিম মিন্টুকে আদালতে হাজির করে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন।
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আফনান সুমি সাইদুলকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ওই দিনই তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। এর আগে গত ১৩ জুন সাইদুলকে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। কিন্তু তিন দিন পরেই তাঁকে রিমান্ড শেষে আদালতে পাঠানো হয়। গত ১১ জুন রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে মিন্টুকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। এরপর তাঁকে ডিবি অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৩ জুন তাঁকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের শেরেবাংলা নগর থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই জালাল উদ্দিন আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুলকে ১৬ জুন কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ইতোপূর্বে এমপি আনার হত্যা মামলায় শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ আমান ওরফে আমানুল্লাহ সাঈদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই জবানবন্দিতে এমপি আনোয়ারুল অপহরণের ঘটনায় সাইদুল করিম মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা বর্ণিত আছে। সাইদুল করিম মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহচর ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুও তাঁর স্বীকারোক্তিতে সাইদুল করিম মিন্টুর জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
তিনি স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার আগে গত ৫ ও ৬ মে মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুলের হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। তখন উভয়ের মধ্যে এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে কথা হয়। হত্যাকা-টি সংঘটিত হওয়ার পর গ্যাস বাবুর মাধ্যমে টাকা দেওয়ার কথা ছিল মিন্টুর।
শিমুল ভূঁইয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পর গ্যাস বাবুর সঙ্গে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মিটিং হয়। ওই মিটিংয়ে গ্যাস বাবু জানান, সাইদুল ২৩ মে টাকা দেবেন। কিন্তু তার আগেই শিমুল ভূঁইয়া তাঁর সহযোগীদের নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আর টাকা দেওয়া হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা রিমান্ড শেষে সাইদুলকে কারাগারে পাঠানোর পর প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেন, ইতোপূর্বে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেওয়া আসামিদের তথ্য ও মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে তা যাচাই করা হচ্ছে।
আনোয়ারুল আজিম গত ১২ মে দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। বরাহনগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু ১৬ মে থেকে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে না পারায় নিখোঁজ জানিয়ে ১৮ মে বরাহনগর থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। গত ২২ মে সকালে আনোয়ারুল আজিম খুন হওয়ার খবর আসে। এরপর তাঁর মেয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় অপহরণের পর গুম করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।
এর আগে এ মামলায় আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, তাঁর ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া, শিলান্তি রহমান ও ঝিনাইদহের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তার করার পর তাঁরা চারজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এখন সর্বশেষ আসামি ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই কোনো ধরনের জবানবন্দি দেওয়া ছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এমপি আনার কন্যার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট উধাও ॥ এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা নিয়ে সামনে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। আর এরই মধ্যে আরও এক রহস্য। এবার ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনারের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।
ডরিনের দাবি, তিনি তাঁর এই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না। গত মে মাসে কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় একটি আবাসনে খুন করা হয় আনারকে। এ খুনের ঘটনায় ঝিনাইদহ এলাকার দুই আওয়ামী লীগ নেতাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। কী কারণে আনারকে খুন করা হয় তার রহস্য উদঘাটন করতে তদন্ত চালাচ্ছে ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগ।