ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে আবেগাপ্লুত পর্যটক

টুঙ্গিপাড়া যেন তুলিতে আঁকা অনবদ্য এক ছবি

নয়ন চক্রবর্ত্তী

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ১০ জুন ২০২৪

টুঙ্গিপাড়া যেন তুলিতে আঁকা অনবদ্য এক ছবি

টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারের আদি বাড়ি

‘যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’ 
বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে প্রবেশের আগে কৃত্রিম ঝরনার প্রবহমান ধারার মাঝে দেখা যায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত কবিতার এ দুটি পঙ্ক্তি। একটি জাতি রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে যিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন, জেল, জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করেছেন, আজ তিনি শুয়ে আছেন স্মৃতিময় টুঙ্গিপাড়ার শীতল ছায়ায়।  
বাইগড় নদের পাশে সেই সমাধিসৌধ। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদিবাড়ি। পুরো এলাকায় হাজারো বৃক্ষের সমারোহ। রয়েছে শতবর্ষী বৃক্ষরাজি। সমাধিসৌধের কমপ্লেক্সজুড়ে প্রকৃতি যেন তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত। বাহারি বৃক্ষে সজ্জিত চারপাশ। শান্ত সমাধিসৌধে শোকের আবেশÑ যা অনুভবে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। 
এক সময়ের অবহেলিত টুঙ্গিপাড়া আজ কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, বকুল, হিজলসহ ফুলে ফুলে রঙিন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হওয়ায় কোনো ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই দ্রুত সময়ে পৌঁছানো যায় টুঙ্গিপাড়ায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো মানুষ ছুটে যান জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে, ছায়াবেষ্টিত-স্মৃতিবিজড়িত টুঙ্গিপাড়া দেখতে। অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার কবর জিয়ারত করতে এসে। 
চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বহর নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় এসেছেন একাত্তরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ। ১৯৭১ সালে ২ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে পাকিস্তানি পতাকায় প্রথম আগুন দেন তিনি। এ ছাড়া, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ করা চট্টগ্রামে মৌলভী সৈয়দ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীদের সঙ্গে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নভেম্বরে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’ শিরোনামে যে মামলা দায়ের করা হয় তার ১ নম্বর আসামি ছিলেন মৌলভী সৈয়দ, ২ নম্বর আসামি ছিলেন প্রয়াত চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও তৃতীয় আসামি ছিলেন হাটহাজারীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান। দায়িত্ব গ্রহণের পর সম্প্রতি নেতাকর্মীদের নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় এসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা স্মৃতিকথা তুলে ধরেন তিনি। 
শুধু চট্টগ্রাম থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ টুঙ্গিপাড়ায় আসেন। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। দলবদ্ধ হয়ে, অনেকে পরিবার নিয়ে আসছেন এখানে। ছবির মতো দৃষ্টিনন্দন টুঙ্গিপাড়া, যেন শিল্পীর আঁকা অনবদ্য এক ছবি। পুরো গোপালগঞ্জ এখন উন্নয়নে পাল্টে গেছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে সড়ক যোগাযোগে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে। 
টুঙ্গিপাড়া এখন হাজার হাজার দর্শনার্থীদের সম্মিলন স্থান। খুলনা থেকে সপরিবারে এসেছেন মো. রফিক মিয়া। তিনি জানান, ১৭ বছর আগে একবার এসেছিলেন। তখন টুঙ্গিপাড়ার অবস্থা ছিল খুবই করুণ। বৃহত্তর ফরিদপুরের কোনো উন্নয়নই করেনি আগের সরকারগুলো। নদীভাঙা এ অঞ্চলগুলোতে কোনো রাস্তা এমনকি ভালো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নির্মাণ করেনি আগের সরকারগুলো। এখন গোপালগঞ্জে সবকিছু আছে। 
টুঙ্গিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস উল্লেখ করার মতো। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপরপ্রান্তে বিশাল এক মার্কেট। সারি সারি দোকান। আছে কয়েকটি মিষ্টির দোকান। সেখানকার দোকানি অনিল বিশ^াস বললেন, শেখ হাসিনা না থাকলে টুঙ্গিপাড়া অজপাড়াগাঁ হয়েই থাকত। বিশ্বাসঘাতকরা পুরো পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে। দুই কন্যা বেঁচে ছিল বলে বাংলাদেশ এখন হাসে। বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন টুঙ্গিপাড়ায় আসেন, তখন মনে হয় আমরা অভিভাবকহীন নই, আমাদের ভয় নাই। 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে শাহাদাতবরণ করেন বঙ্গবন্ধু। পরদিন টুঙ্গিপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে মা ও বাবার পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এ সমাধিসৌধ ঘিরেই টুঙ্গিপাড়ায় এখন সবকিছু।
সমাধি কমপ্লেক্সজুড়ে পাখির কলতান আর সবুজের ঘ্রাণ। সমাধিসৌধ সাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত, যা বেদনার চিহ্ন হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পীরা। গোলাকার গম্বুজবিশিষ্ট মূল সমাধিসৌধে বাবা-মায়ের কবরের পাশেই বঙ্গবন্ধুর কবর। মূল সমাধিসৌধের চারদিকে দেওয়ালে দিনরাতের আলো আসার জন্য রাখা হয়েছে আলাদা খোপ, যার কারণে সরাসরি সূর্যরশ্মি ও চাঁদের আলো এসে পড়ে এখানে। 
মূল সমাধি পার হয়ে হাতের বাম দিকে শেখবাড়ি জামে মসজিদ। এর পরই শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী আদিবাড়ি। এর পাশেই দুটি সাইনবোর্ড। একটিতে দুটি আলোকচিত্র রয়েছে- বাড়িটির আগের চিত্র এবং সংস্কার সংরক্ষণের পরের চিত্র। অপর সাইনবোর্ডে রয়েছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর তিন পৃষ্ঠার কথামালা।
সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সে প্রবেশের মূল ফটকের সামনে প্রশস্ত জায়গা। কমপ্লেক্সে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। একটি পাঠাগার ও জাদুঘর আছে দ্বিতলবিশিষ্ট। জাদুঘরে আছে বঙ্গবন্ধু ও তার পিতার কফিন, পারিবারিক ছবিসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ছবি। 
জাতির পিতার সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের ১ নম্বর গেট ধরে কিছুদূর এগোনোর পরই হিজল গাছ। তার সামনেই শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী ‘বড় তালাব’ (পুকুর)। সেই পুকুরপাড়েই ঝিঁঝিঁ পোকা আর কোকিলের ডাক থাকে সারাক্ষণ। এর পরই সমাধিসৌধ। যেখানে সমাহিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে এখন সহজ যোগাযোগ। টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত বঙ্গবন্ধু ক্রমাগত টানেন বাঙালি জাতিকে। বাঙালির মহানায়কের সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ভক্তরা ছুটে যান প্রিয় টুঙ্গিপাড়ায়।

×