ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

নেত্রকোনায় জঙ্গি আস্তানায় তল্লাশি শেষ 

বোমা ও বিস্ফোরকসহ বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার

নিজস্ব সংবাদদাতা, নেত্রকোনা 

প্রকাশিত: ২১:১১, ৯ জুন ২০২৪

বোমা ও বিস্ফোরকসহ বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার

বোমা ও বিস্ফোরক

সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ভাসাপাড়া এলাকার জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পিস্তুল, ম্যাগাজিন ও গুলি উদ্ধারের পর রবিবার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা এবং বিস্ফোরকসহ জঙ্গি তৎপরতার বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে পুলিশ। রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, সোয়াট ইউনিট ও বোম ডিসপোজাল ইউনিটের বিশেষজ্ঞ দল এ তল্লাশি অভিযান চালায়। তল্লাশি শেষে বোম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা আশপাশের বাড়িঘরের লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে ছয়টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা (আইইডি) নিষ্ক্রিয় করে। এ সময় বিকট শব্দে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। 

ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ শাহ আবিদ হোসেন ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুল্লাহ চৌধুরী, বোম ডিসপোজাল ইউনিটের বোমা বিশেষজ্ঞ পুলিশ সুপার সানোয়ার হোসেন এবং নেত্রকোনার পুলিশ সুপার ফয়েজ আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত দিনব্যাপী এ তল্লাশি অভিযানে মোট ৮০ ধরনের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। রবিবার উদ্ধার করা সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে: ৬টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা (আইইডি), ১টি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি, ২টি মার্শাল আর্ট ড্রেস, ২টি ফ্লøাশ লাইট, ৫টি এন্ড্রয়েড ফোন, ৭টি বাটন ফোন, ২টি হাই পাওয়ার দূরবীন, সিলিকনের তৈরি একটি মানবাকৃতির পাঞ্চিং বক্স, পাঞ্চিং ব্যাগ, প্লাস্টিকের ২০টি ডামি রাইফেল, ১টি রাম দা, ১টি পাসপোর্ট, ২টি অত্যাধুনিক কম্পাস, ১টি ইলেক্ট্রিক করাত, ৩০টি বেল্ট, ১টি ল্যাপটপ, ১টি প্রিন্টার, ১টি নানচাকু ও ৬টি প্যাকেটবন্দী সিসি ক্যামেরা প্রভৃতি। এর আগে শনিবার উদ্ধার করা হয় ১টি বিদেশী পিস্তল, ১৭ রাউন্ড গুলি, ২টি ম্যাগাজিন, ১টি হ্যান্ডকাপ ও ২টি ওয়াকিটকি। রবিবার সন্ধ্যায় এসব সরঞ্জাম সাংবাদিকদের দেখানো হয়। 

তল্লাশি অভিযানের পর ডিআইজি মোঃ শাহ আবিদ হোসেন তাৎক্ষণিক প্রেসব্রিফিংয়ে বলেন, ‘ডুয়েটের সাবেক শিক্ষক প্রফেসর আব্দুল মান্নানের বাড়িটিতে হামিম হোসেন ফাহিম ওরফে আরিফ নামের এক যুবকসহ কয়েকজন ভাড়া থাকতো। এই আরিফ গত ৫ জুন নরসিংদীর রায়পুরায় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়। ওই ঘটনার সূত্র ধরে এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রফেসর আব্দুল মান্নানের সঙ্গে গতকাল পর্যন্ত পুলিশের যোগাযোগ ছিল। তিনি সদর মডেল থানার ওসির সঙ্গে কয়েকবার কথাও বলেছেন। কিন্তু আজ (রবিবার) তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোনটি বন্ধ রয়েছে। এই জঙ্গি আস্তানার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে আপাতত এর বাইরে আমরা আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।’ 

নরসিংদীর রায়পুরা থানায় দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা গেছে, ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া হামিম হোসেন ফাহিম ওরফে আরিফের (৩২) বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার উত্তর বালিহাড়ি (মাঝিবাড়ি) গ্রামে। তার বাবার নাম সেলিম মিয়া।  

জানা গেছে, শনিবার দুপুরে প্রথম নেত্রকোনা মডেল থানা পুলিশ ভাসাপাড়া গ্রামে উঁচু দেওয়ালে পরিবেষ্টিত ও অত্যন্ত সুরক্ষিত দোতলা বাড়িটিতে অভিযান শুরু করে। সন্ধ্যা নাগাদ সে অভিযানে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১৭টি গুলি, ২টি ওয়াকিটকি, ১টি হাতকড়া ও ১ বস্তা জিহাদি বই উদ্ধার করে। এরপর অ্যান্টিটেররিজম ইউনিটের সদস্যরা এসে নিশ্চিত হয় যে, বাড়িটিতে বিষ্ফোরক দ্রব্য রয়েছে। তখন তারা অভিযান স্থগিত রেখে বোম ডিসপোজাল ইউনিট ও সোয়াট টিমকে খবর পাঠায়। রবিবার সকালে ওই দুটি টিমের সদস্যরা এসে দ্বিতীয় দফা অভিযান পরিচালনা করে। 

অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া বোম ডিসপোজাল ইউনিটের পুলিশ সুপার সানোয়ার হোসেন বলেন, বাড়িটি জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো, এ বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত। এখানে যে ধরনের এক্সক্লুসিভ ডিভাইস পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ২০১৭ সালে মোহাম্মদপুরে একটি জঙ্গি আস্তানায় উদ্ধার করা সরঞ্জামের মিল রয়েছে। জেলা পুলিশ সুপার ফয়েজ আহমেদ বলেন, বাড়িটির ভিতরের একটি কক্ষ সাউন্ডপ্রুফ করা ছিল। একটি ব্যায়ামাগারও রয়েছে। এমনকি কারাতে বা মার্শাল আর্টের সরঞ্জামও পাওয়া গেছে। সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, এটি ১৫-২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার উপযোগী একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভাসাপাড়া এলাকার নির্জন স্থানে ২শ ৪০ শতক জমির ওপর নির্মিত ওই বাড়িটি প্রায় ২০ বছর আগে নির্মাণ করা হয়। বাড়িটির মালিক আটপাড়া উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের প্রফেসর ইঞ্জিনিয়ার ড. আবদুল মান্নান। তিনি ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) শিক্ষক ছিলেন। তিনি সেখানে একটি মহিলা কলেজ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা আর করেননি। দুই বছর আগে বাড়িটি তিনি ওই আরিফ নামক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেন। বাড়ির ভেতরে থাকা দুটি বড় পুকুরে মাছ চাষ করা হয়।

 এ ছাড়া প্রাচীরের ভেতরে একটি আধা পাকা টিনের ছাউনি ঘর আছে। ভাড়া দেওয়ার পর ভাড়াটিয়ারা বাড়ির সীমানাপ্রাচীর আগের চেয়ে আরও দেড় ফুট উঁচু করেন। এর ফলে ওই বাড়ির কিছুই বাইরে থেকে দেখা যায় না। বাড়িটির নারকেলগাছ, আমগাছসহ সীমানাপ্রাচীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০টির মতো সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়। ওই বাড়িতে স্থানীয় কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক প্রতিবেশী বলেন, ‘বাড়িটিতে দুজন পুরুষ, দুজন নারী ও চার-পাঁচটি বাচ্চা অবস্থান করত। তাছাড়া গভীর রাতে একটি জিপ গাড়িতে করে আরও কয়েকজন যাওয়াআসা করত।  তারা খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করত। স্থানীয় কারও সঙ্গে মিশতো না। এমনকি বাড়িটির ভেতরে বা সীমানার বাইরে কাউকে আসতে দিত না। বাড়িটি দেখে আমাদের অনেক আগে থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল।’

জানা গেছে, জেলা শহরের বনোয়াপাড়া এলাকাতেও প্রফেসর আব্দুল মান্নানের আরও একটি বাড়ি রয়েছে। তাতে একটি প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কার্যক্রম চলমান। ওই বাড়িতেও পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। এছাড়া বনোয়াপাড়ার নেওয়াজ নগর এলাকারও একটি বাড়ি পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। নেত্রকোনা মডেল থানার ওসি আবুল কালাম বলেন, এ ব্যাপারে মামলার প্রস্তুতি চলছে। 

 

শহিদ

×