মঠবাড়িয়ায় রেমালের তাণ্ডবে উপড়ে পড়ে বহু গাছপালা, বিধ্বস্ত হয় আধাপাকা ঘর, দোকানপাট
ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূল অতিক্রম করে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লেও রেখে গেছে ভয়াবহ তা-বের ক্ষত। বসতবাড়ি, জমির ফসল, ঘেরের মাছ হারানো সেই ক্ষতের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের চাপা কান্না মিলে উপকূলের আকাশ-বাতাস ভারি করে তুলেছে। উপকূলের বিধ্বস্ত জনপদ জানান দিচ্ছে রেমালের ভয়াবহতা। বিপর্যস্ত জনপদে ফুটে উঠেছে রেমালের তা-বের ক্ষত।
ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিক ধারণাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মানিকগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার অবস্থান থেকে স্থল নিম্নচাপটি উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে সিলেট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় কিছুটা ঝড়োবাতাস থাকলেও জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানি নামতে শুরু করেছে।
আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার পরিবারগুলো। বাড়ি ফিরেই নতুন করে সংকটে পড়েছে উপকূলবাসী। ৩০ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও স্বাভাবিক হয়নি বিদ্যুৎ পরিস্থিতি। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক এখনো অচল। উপকূলের বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে সুপেয় পানি নিয়ে। উপকূলের গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। পানির অভাবে রান্নাবান্না করতে না পারায় নিম্নাঞ্চলের পরিবারগুলো অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
গত রবিবার সন্ধ্যায় ১২০ কিলোমিটার বেগে সুন্দরবন দিয়ে উপকূলে আঘাত হানে রেমাল। জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলাসহ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন এলাকা। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টির তা-বে উপকূলের বিভিন্ন এলাকা কয়েক ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়। ডুবে যায় বেড়িবাঁধ, তলিয়ে যায় উপকূলীয় জেলাগুলোর নিচু এলাকা। ভেসে যায় মাছের ঘের। এলাকাবাসী বলছেন, জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানায় জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা বেশি ছিল। ১৯৭০ সালের পর জোয়ারে এত পানি কখনো হয়নি বলে জানান তারা।
ঝড়ের প্রভাবে বাড়িঘর, গবাদিপশু, মাঠের ফসল, খেতের ফল, সবজি ও প্রচুর গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত রাজধানীসহ ১০ জেলায় অন্তত ২১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। রেমালের তা-বে ঢাকায় চার, ভোলায় তিন, বরিশালে তিন, পটুয়াখালীতে তিন, চট্টগ্রামে দুই, খুলনা, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, বরগুনা, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ২১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
আর রেমালের প্রভাবে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে চাঁদপুরে ২৫৭ মিলিমিটার, দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম ও সিলেটে ২৪৯ মিলিমিটার, তৃতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা ২২৪, চতুর্থ অবস্থানে শ্রীমঙ্গলে ২১৮, পঞ্চম অবস্থানে মাদারীপুরে ২০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
এ ছাড়া ১০০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি হয়েছে বান্দরবানে ১৭৮, সন্দ্বীপে ১৭৬, গোপালগঞ্জে ১৬৭, কুতুবদিয়া ও ফেনীতে ১৬২, বরিশালে ১৪৭, পটুয়াখালীতে ১৪৫, মোংলায় ১৩৭, খুলনায় ১২৫, কুমিল্লায় ১২২, হাতিয়া ও সীতাকু-ে ১১২, টাঙ্গাইলে ১০৭, মাইজদীকোর্টে ১০৪ মিলিমিটার। এর বাইরে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে কম-বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চারজনের মৃত্যু ॥ রবিবার রাত থেকে ঢাকায় শুরু হওয়া ঝড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ছিল। তবে সকালেই মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঠেছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশের অন্যান্য জেলার মতো রাজধানী ঢাকাতেও ভারি বৃষ্টি হয়েছে। আর এই বৃষ্টির মধ্যেই টিনের বেড়া, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে স্পর্শ, বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা চার্জ দিতে গিয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
তারা হলেন- মরিয়ম বেগম (৪৫), লিজা আক্তার (১৫), মো. রাকিব (২৫) ও আলামিন (২২)। সোমবার রাতে রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও, উত্তর বাড্ডায় ও যাত্রাবাড়ীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের আলাদা চারটি ঘটনায় তারা প্রাণ হারান। তবে রেমালের কারণে বৃষ্টিতে ঢাকার অনেক এলাকায় মঙ্গলাবরও জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। এ ছাড়া প্রধান সড়কে পড়া গাছপালা সরিয়ে নিলেও অলিগলিতে ভেঙে পড়া ডালপালা মঙ্গলবার পর্যন্ত পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
আমাদের স্টাফ রিপোর্টার, নিজস্ব সংবাদদাতা ও সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেয়ারের পানি নামতে শুরু করায় উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তা-বের ক্ষতি ফুটে উঠছে। আবাদি কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুকুর, মাছের ঘের ও বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে উপকূলের নি¤œাঞ্চলের মানুষ। পানি সংকট, বিদ্যুৎ সংকট আরও বিপর্যন্ত করে তুলেছে উপকূলের পরিবারগুলোকে।
রেমালের প্রভাবে জোয়ারে বাঁধ ও রাস্তা ভেঙে বাড়িঘর ও জনপদ তলিয়ে গেছে। এত পানি, এমন ভয়াবহ অবস্থা সিডরের সময়েও দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে রেমালের প্রভাবে নি¤œাঞ্চলের পরিবারগুলো অসহনীয় কষ্টে দিন যাপন করছে।
ভোলা ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর অস্বাভাবিক জোয়ারে তলিয়ে গেছে ভোলার চরফ্যাশনের পাঁচ হাজার পরিবারের বাড়িঘর। সোমবার সন্ধ্যায় তেঁতুলিয়া নদীতে আকস্মিক জোয়ারে তলিয়ে গেছে উপজেলার চরকলমির পাঁচ হাজার পরিবারের বাড়িঘর। হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে পানি ঢুকতে থাকায় বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রসহ উঁচু রাস্তাতে আশ্রয় নেন লোকজন। এমন অবস্থায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়।
স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সোমবার দিনভর দমকা হাওয়া ও ঝড়োবৃষ্টি ছিল। শেষ বিকেলে হঠাৎ বাতাসের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং মুষলধারে বৃষ্টি হতে থাকে। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতে সন্ধ্যার আগেই কয়েকটি গ্রাম পাঁচ থেকে সাত ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। তীব্র স্রোতে ভেসে যায় মালামাল। আতঙ্কিত হয়ে লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান। কিছু সময়ের মধ্যে রাস্তা তলিয়ে গেলে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়।
চাঁদপুর ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে চাঁদপুর শহররক্ষা বাঁধের আটটি স্থানে অন্তত ১৬৫ মিটার সিসি ব্লক ধসে মেঘনা নদীতে দেবে গেছে। সোমবার দিনভর টানা বৃষ্টিপাত ও মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে বিকেলে বাঁধে ভাঙন ধরে। তাৎক্ষণিকভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধে কাজ শুরু করে।
দুপুরের পর থেকে ঢেউয়ের তীব্রতা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি টানা বৃষ্টি ও ঝড়োহাওয়ায় কয়েক ফুট উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে তীরে। পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে ভাঙন আতঙ্কে নদী তীরের অনেক লোকজন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। এখনো স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বরগুনা ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ল-ভ- হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা বরগুনা। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, মাছের ঘের ও বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছপালা উপড়ে গেছে। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর থেকেই গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহরের কিছু স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলেও জেলার ছয়টি উপজেলার কয়েক লক্ষাধিক মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে।
সবকিছু সচল করতে মাঠে কাজ করছে প্রশাসন। রেমালে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হাজারো পরিবারের সদস্যরা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বরগুনায় অন্তত ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার ৩৭৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ১৩ হাজার ৩৪টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বরগুনা সদরের আয়লাপাতাকাটা ইউনিয়নের লেমুয়া গ্রামের আ. রহিম বয়াতী (৫৫) নামে এক ব্যক্তি গাছচাপায় নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত। জলোচ্ছ্বাসে বন্যাদুর্গত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুই লাখ ৩১ হাজার ৭০০ মানুষ। বরগুনা জেলা প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রেমালের আঘাতের পর জেলার প্রধান তিন নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ ফুট উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হয়েছে।
জলোচ্ছ্বাসে পায়রা ও বিষখালী নদীর তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ১২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডুবে গেছে চার হাজার ১৫৭ হেক্টর মাছের ঘের ও উন্মুক্ত জলাশয়। পানিবন্দি আছেন কয়েক হাজার মানুষ। দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। এ ছাড়াও জেলার দুটি ফেরিঘাট ডুবে গেছে, গাছপালা ভেঙে ও ঘরবাড়িতে চাপা পড়ে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। কেউ নিখোঁজ হননি।
সোমবার রাত ১০টা পর্যন্ত শহর এবং উপকূলীয় এলাকায় দমকা হাওয়াসহ মাঝারি ও ভারি বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আকাশ মেঘলা রয়েছে। হালকা-পাতলা বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। পায়রা ও বিষখালী নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে ঝড়োহাওয়ার সঙ্গে ভারি বৃষ্টি বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় পানি বেড়ে যায়। রাতে নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করে, প্লাবিত হয় সড়ক ও মাছের ঘের। ডুবে যায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাকিব বলেন, ‘বরগুনা সদরের ডালভাঙ্গা, লতাবাড়িয়া, মোল্লারহোরা, মাঝখালী, আয়লাপাতাকাটা, আরপাঙ্গাশিয়া, তেঁতুলবাড়িয়া এবং পাথরঘাটার কাকচিড়া, রুহিতা, জিনতলা, চরলাঠীমারা, কাঁঠালতলী, চরদুয়ানি পদ্মা এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে এসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দ্রুত মেরামত করা হবে।’
জেলা প্রশাসন জানায়, রেমালের তা-বে পায়রা ও বিষখালী নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে নয় থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে ৩০০টি গ্রাম। বিভিন্ন উপজেলায় তিন হাজারের বেশি গাছপালা উপড়ে গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর। বন্যাদুর্গত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুই লাখ ৩১ হাজার ৭০০ মানুষ। অধিকাংশ উপজেলা বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। গাছপালা পড়ে ৩৭ জন আহত হয়েছেন।
এ বিষয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে অধিংকাংশ স্থানে খুঁটি ও গাছপালা ভেঙে পড়ায় পুরো জেলা বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪০৮টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কম-বেশি দুই লাখ ৩১ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তথ্য সংগ্রহের কাজ এখনো চলমান আছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আমরা এখনো উপকূলীয় এলাকাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করছি।
পটুয়াখালী ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে পটুয়াখালীতে কৃষি, মৎস্য, বিদ্যুৎ, বেড়িবাঁধ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিদ্যুৎ, মৎস্য ও ফসলের। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আধাপাকা-কাঁচা ঘরবাড়ি। সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলো হলো কলাপাড়া, দশমিনা ও রাঙ্গাবালী। এই উপজেলায় পানির তোড়ে ভেসে গেছে ৭৭৫টি ঘের।
কলাপাড়া, রাঙ্গাবলী ও দশমিনায় চাষিদের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে মৎস্য বিভাগ জানায়, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে কলাপাড়ায় পাঁচ কোটি, রাঙ্গাবালীতে চার কোটি ও দশমিনায় তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া এ জেলার অপর উপজেলাগুলোতে ধান, মুগ ডাল, চীনা বাদাম, কলা, পান ইত্যাদি ফসল নষ্ট হয়েছে। টাকার অঙ্কে প্রায় ২৬ কোটি টাকা।
ঘূর্ণিঝড় রেমালে প্রায় ৫৮ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যার মধ্যে ১৮ হাজার কৃষককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রণোদনা দেবে কৃষি বিভাগ। বন্যায় বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকার।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের তা-বে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় হাজারো ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ল-ভ- হয়ে গেছে গাছপালা। ভেসে গেছে হাজার হাজার পুকুর-ঘেরের মাছ। সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে সবজির আবাদ। রক্ষা হয়নি আউশের আবাদ। বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত নয় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। উপজেলার অন্তত ১২টি গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছেন।
সবচেয়ে বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধের বাইরের, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজারো পরিবার। কাউয়ার চরের জেলে মুসা জানান, স্ত্রী তানিয়াসহ দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব। ঝুপড়ি ঘরটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। গবাদিপশু ভেসে গেছে। পরিবারটির সবাই চরম বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছেন। একই দশায় জহিরুলের পরিবার। টিনশেড ঘরটি ল-ভ- হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন পোল্ডারের বেড়িবাঁধের ২২টি পয়েন্টে অন্তত নয় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিজকাটা গ্রামের কৃষক জানান, তাদের পুরনো বিধ্বস্ত বাঁধসহ স্লুইসগেট এলাকা থেকে লোনা পানি অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। বাঁধের অন্তত ১১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। রেমাল তা-বে কলাপাড়ার মৎস্য সেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অফিস সূত্রে জানা গেছে, কলাপাড়ায় ৪৬৯০টি পুকুর ও ৭৭৮টি মাছের ঘের ডুবে ভেসে গেছে মাছ। এতে অন্তত ২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
পটুয়াখালীর বাউফলে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তা-বে মৎস্য, কৃষি, সড়ক, বিদ্যুৎ, বনজ ও গ্রামীণ অবকাঠামোগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা।
উপজেলা সিনিয়ার মৎস্য কর্মকর্তা মাহাবুব আলম তালুকদার জানান, রেমালের প্রভাবে উপজেলার চার হাজার পুকুর, ৫০টি মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। ৭০ লাখ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা পানিতে ভেসে গেছে।
অবকাঠামোসহ মোট চার কোটি ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাউফল জোনাল অফিসের ডিজিএম মজিবুর রহমান জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তাদের ১৫টি খুঁটি ভেঙে গেছে এবং দুইশ’ পয়েন্টে তার ছিঁড়ে গেছে। এ ছাড়াও দুইশ’র বেশি ইনসোলেটর বিনষ্ট হয়েছে।
চন্দ্রদ্বি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলকাস মোল্লা জানান, তেঁতুলিয়ার মধ্যবর্তী তার ইউনিয়নের ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের খানকাবাজার থেকে দক্ষিণে ছালাম হাওলাদার বাড়ি পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার, দিয়ারা কচুয়া খেয়াঘাট থেকে উত্তরে স্লুইসগেট পর্যন্ত এক কিলোমিটার, চরনিমদি খেয়াঘাট থেকে দক্ষিণে তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কক্সবাজার ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে কুতুবদিয়ায় বাতাস ও ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রায় তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ৫০টি কাঁচা ঘরবাড়ি বিধস্ত হয়েছে। বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে লোকালয়ে। একাধিক স্থানে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তেলিপাড়া এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে সমুদ্রের লোনা পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।
লোকালয়ের সমতল ভূমিতে সাগরের লোনা জল ঢেউ খেলছে। তাছাড়া কৈয়ারবিল ইউনিয়নের উত্তর কৈয়ারবিল এলাকায় বেড়িবাঁধে ভাঙন ধরেছে। কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়ন ও কৈয়ারবিল ইউনিয়নের প্রায় তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নোয়াখালী ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট অস্বাভাবিক জোয়ারের তোড়ে নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের প্রধান সড়কের চেউয়াখালী কাঠের সেতুটি ভেসে গেছে। এতে দ্বীপের ১৫ হাজারের বেশি বাসিন্দা যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। সোমবার দুপুরে জোয়ারের সময় সেতুটি ভেসে যায়।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফেরার পথে পানিতে পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিহত মো. মান্না (১২) উপজেলার নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুর গ্রামের মোক্তার বাড়ির নবীর উদ্দিনের ছেলে। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে।