মৃত হরিণ উদ্ধার।
নজীর বিহীন জলোচ্ছাসসহ দীর্ঘ ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রক্ষা কবজ সুন্দরবন ক্ষত-বিক্ষত। কত প্রাণী মারা গেছে, আর কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বন বিভাগ জানাতে পারেনি।
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী সুন্দরবনের ৬ কোটি টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে বলে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন। জীব বৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে কাজ চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো এসময় জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শরণখোলা রেঞ্জের কটকা-জামতলা এলাকা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৯টি হরিণের এবং একটি বণ্য শুকরের মৃতদেহ বন বিভাগের কর্মীরা উদ্ধার করেছেন। এছাড়া, ভেসে যাওয়া ১৭টি হরিণ নদী ও খাল থেকে উদ্ধার করে পরিচর্যার পর বনে অবমুক্ত করা হয়েছে। মৃত হরিণগুলো কটকাতে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।
তার ভাষায়, ‘উচ্চ জোয়ারের পানি সুন্দরবনে গহীনে উঠে যাওয়ায় হরিণগুলো ভেসে গিয়ে সাঁতরে কূলে উঠতে না পেরে মারা যেতে পারে বলে ধারণা করছি।’
প্রশ্ন ছিল ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবনের কেবলমাত্র ৫ বর্গ কি.মি. কটকা-জামতলা এলাকা থেকে যদি ৩৯টি মৃত হরিণ ও একটি বণ্য শুকর পাওয়া যায়, তাহলে রেমালে কত প্রাণি মারা গেছে গোটা সুন্দরবনে। এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ঘুর্ণিঝড় রেমালের সময় অভূতপূর্ব জলোচ্ছাস ছিল। এত পানি আর কোনদিন সুন্দরবনে হয়নি। সেই সাথে ছিল দীর্ঘক্ষণ প্রবল বাতাস ও বৃষ্টি। তাই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছি।’
সুন্দরবন রেমাল’র আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘লন্ডভন্ড বলা ঠিক হবে না। কারণ, অবকাঠামোর কিছু ক্ষতি হলেও বৃক্ষ-গাছপালার খুব বেশি ক্ষতি হয়নি বলে প্রাথমিক জরিপে মনে হচ্ছে। তবে ৮ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত পানির কারণে কিছু বণ্যপ্রানী মারা গেছে। তবে এ পর্যন্ত বাঘের কোন মৃত দেহ পাওয়া যায়নি। রবিবার বিকাল থেকে একটানা ২৪ ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব ও জলোচ্ছাস চলেছে। প্রাণ প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বনের অভ্যন্তরে প্রাণি ও বনজীবীসহ বনকর্মীদের মিষ্টি পানির সকল পুকুর জলোচ্ছাসের লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে। যার ফলে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী, বনজীবী ও বন বিভাগের স্টাফদের খাবার পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গাছপালার কিছু ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বনবিভাগের বিভিন্ন বনঅফিসসহ টহল বোট, টিনের চালা, জানালা-দরজা সোলার প্যানেল ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছাসের কবলে কটকা অভয়াণ্যে অফিস ঘাটের জেটি ও পুকুর বঙ্গোপসাগরে বিলিন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কোচিখালি, বগিসহ বিভিন্ন বনঅফিস ও টহল ফাঁড়ির রান্নাঘর এবং অবকাঠামোর চালা উড়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির যথাযথ নিরুপনের জন্য বন বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন।’
এদিকে, সুন্দরবন সংলগ্ন রায়েন্দা বেড়িবাধ এলাকায় বলেশ্বর নদ থেকে স্থানীয়রা তিনটি মৃত হরিণ ভেসে যেতে দেখেছেন। সুন্দরবনের দুবলার মাঝের কেল্লা সাইক্লোন সেল্টার এলাকায় সাগরে একটি মৃত হরিণ ভাসতে দেখা যায় বলে মুঠোফোনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন জেলে আলালমিয়া। প্রবলবৃষ্টি ও ঝড়োহাওয়া বইতে থাকায় মৃত ওই চারটি হরিণউদ্ধার করতে পারেনি তারা।’
তবে বনপ্রেমীরা বলছেন, ‘অনেক বণ্যপ্রাণী মোলের আঘাতে মারা গেছে। তাছাড়া, মিঠা পানির উৎস পুকুরগুলো জলোচ্ছাসে লোনা পানিতে তলিয়ে যাওযায় বনকর্মী ও বনজীবীদের পাশাশাশি বাঘ. হরিন, বানর, শুকরসহ বন্য প্রাণীদের সুপেয় পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বণ্যপ্রাণিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত এবং নানা রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত হবার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘ ঘূর্ণিঝড় ও অতিরিক্ত জলোচ্ছাসে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী সুন্দরবনের ৬ কোটি টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবনের গাছপালা ও বণ্যপ্রাণির ক্ষয়ক্ষতির সঠিক চিত্র নিরুপণে বনবিভগর সকল স্টাফ একযোগে কাজ করছে। প্রয়োজনে সাম্ভব্য সকল পদ্বতি প্রয়োগ করে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য আগামী কয়েদনের মধ্যে জানা যাবে।’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহম্মদ নূরুল করিম বলেন, আবহওয়া স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে আমরা ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে সুন্দরবনের গাছপালা, অবকাঠামোসহ বণ্যপ্রার কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপনে সরেজমিনে কাজ করছি।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ‘আসলে সিডর-আইলার চেয়েও এবার পানি অনেক বেশি ছিল। সুন্দরবনে আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে এত পানি আগে কখনও দেখিনি। সাধারণ জোয়ারের চেয়ে অন্তত পাঁচ থেকে সাত ফুট বেশি উচ্চতায় পানি উঠেছে করমজলে। কেন্দ্রের রাস্তাঘাট থেকে প্রায় সব জায়গায় কোমর সমান পানি হয়। সাগর উপকূলে বনের দুবলা, কটকা, কচিখালী এলাকায় পানি আরও কয়েক ফুট বেশি ছিল। যেহেতু বনের সব জায়গা তলিয়ে গেছে, এতে বন্যপ্রাণীর বেশ ক্ষতি হওয়ার কথা। অবশ্য বন্যপ্রাণীরা ঝড়-বন্যার সঙ্গে অনেকটাই খাপ খাইয়ে চলতে পারে। তবে হরিণ শাবক ভেসে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’ জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে করমজল প্রজননকেন্দ্রের কুমির, কচ্ছপসহ অন্যান্য প্রাণীর কোনো ক্ষতি হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘ভৌগোলিকভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার জনপদ ও বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে সুন্দরবনের অবস্থান। বরাবরের মতো এবারও প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থেকে উপকূল রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এ বনটি।’
সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘সুন্দরবন আমাদের উপকূলকে ঠিক মায়ের মতো বুকে আগলে রাখছে। ঝড়ের সময় সে নিজে ক্ষত-বিক্ষত হলেও উপকূলের তেমন ক্ষতি হতে দেয় না। তবে এবার গাছপালা ও অবকাঠামোর পাশাপাশি অনেক বণ্যপ্রাণী মারা গেছে বলে ধারণা করছি। এ ব্যাপারে দ্রুত সঠিক তথ্য বন বিভাগ জানাবে বলে তিনি আশা করেন।’
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, ‘২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আছড়ে পড়লেও সুন্দরবনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, প্রাণহানিও হয়েছিল আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেয়ালের মতো কাজ করে সুন্দরবন। তবে ঝড়ের ফলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।’
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আছড়ে পড়লেও সুন্দরবনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, প্রাণহানিও হয়েছিল আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেয়ালের মতো কাজ করে সুন্দরবন। তবে ঝড়ের ফলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।