গাবতলীতে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করে সড়ক তৈরির প্রস্তুতি
তীব্র গরম ও অতি বৃষ্টি থেকে সড়কের বিটুমিন রক্ষা এবং সড়ক স্থায়িত্বের জন্য পিচের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর মোহাম্মদপুর গাবতলী-সদরঘাট সড়কটিতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে অন্যান্য সড়কেও বিটুমিনের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারের পরামর্শ সড়ক ও মহাসড়কের বিভাগের।
সারাদেশে গত কয়েক সপ্তাহের টানা গরমে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের বিটুমিন বা পিচ নরম হয়ে দেবে গেছে। অনেক স্থানে সড়কের মাঝখানে পিচ দেবে ড্রেনের মতো হয়ে গেছে। এতে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি যশোর জেলার বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে। এতে কমে যাচ্ছে যানবাহনের গতি। তাই ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে বলে চালকরা জানান।
এর মধ্যে ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের বিষয়খালী এলাকা বেহাল হয়ে পড়েছে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে বিটুমিন বা পিচ নরম হয়ে দেবে গিয়ে ড্রেনের মতো হয়েছে। দেখলে মনে হবে, সড়কের মাঝখানে ডিভাইডার। এই সড়কের অন্তত ছয় জায়গায় এভাবে লম্বালম্বিভাবে উঁচু হয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানান। এতে সড়কটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়কটি দ্রুত সংস্কারের দাবি স্থানীয়দের। তাই তীব্র গরম ও অতি বৃষ্টি থেকে সড়কের বিটুমিন রক্ষায় প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ।
এ বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সড়কের স্থায়িত্বের জন্য বিটুমিনের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিশোধন করে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর মোহাম্মদপুর গাবতলী-সদরঘাট সড়কটিতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে।
ভবিষ্যতে অন্যান্য সড়কেও বিটুমিনের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারের চিন্তাভাবনা রয়েছে। এর ফলে তীব্র গরম ও অতি বৃষ্টি থেকে সড়কের বিটুমিন রক্ষা এবং সড়ক স্থায়ী হবে বলে জানান তিনি।
সওজের কর্মকর্তারা জানান, অন্যান্য দেশে সড়কের শুধু উপরিভাগে (সারফেস কোর্সে) পিচের সঙ্গে প্লাস্টিক মেশানো হয়। সড়ক নির্মাণে যত উপাদান ব্যবহৃত হয়, এর মাত্র ৫ শতাংশ বিটুমিন। তাতে ৮ শতাংশ প্লাস্টিক মেশানো হয়। বাংলাদেশে শুধু পিচ ঢালাইয়ের নয়, নিচের স্তরে (বেইজ কোর্স-১) পাথরের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
তাই অন্য দেশের তুলনায় বেশি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে। বৃষ্টি এবং অতিরিক্ত পণ্য বহনে সড়ক নষ্ট হয়। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমবর্ধমান উষ্ণতায় সড়কে রাটিং (উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়া) এবং ডিসট্রেস (ফেটে যাওয়া) বাড়ছে। প্লাস্টিকের ঢালাইয়ে রাটিং হয় না। আবার বিটুমিন এবং পাথর আমদানি কমবে বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে কিছু সড়কে পরীক্ষামূলকভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। সড়কের স্থায়িত্বের জন্য যদি এটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী হয় তা হলে ভবিষ্যতে অন্যান্য সড়কের বিষয়টিও চিন্তা করা হবে।’
তবে গরমে পিচ গলে যাওয়া নিয়ে সড়কের বিটুমিনের মান নিয়ে সন্দেহ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নি¤œমানের বিটুমিন দিয়ে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বেশিরভাগ সময় ৫২ থেকে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকার পরও সড়কের পিচ গলে না।
আমাদের এখানে ভেজাল বিটুমিন ব্যবহার করা না হলে মাত্র ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পিচ গলে যাওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশে সাধারণত সড়ক-মহাসড়কে যে পিচ ব্যবহার করা হয় তার মান ৬০-৭০ গ্রেডের। এই পিচের গলনাঙ্ক ৪৯-৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে পিচ গলে যাওয়ার কথা।
কিন্তু গত কয়েক দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০-৪৩ ডিগ্রি। এই তাপমাত্রায় পিচ গলে যাওয়ায় ব্যবহৃত পিচের মান নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত বিটুমিন ব্যবহার ও সড়ক নির্মাণ ত্রুটিকে দায়ী করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ॥ অতিরিক্ত বিটুমিন ব্যবহার ও সড়ক নির্মাণ ত্রুটির কারণে এ সমস্যা বেশি হচ্ছে। তবে নি¤œমানের বিটুমিনের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘তীব্র তাপমাত্রা শুধু আমাদের এখানেই নয়।
সৌদি আরবসহ বিশে^র অন্যান্য দেশেও আমাদের থেকে বেশি তাপমাত্রা রয়েছে। কিন্তু তাদের ওখানে তো সড়কের বিটুমিন এভাবে গলে যাচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে আমাদের এখানে সড়ক নির্মাণ ত্রুটি রয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত বিটুমিন ব্যবহারের কারণেও হতে পারে।
দেখা যায় যেখানে যে পরিমাণ বিটুমিন দরকার, সেখানে সে পরিমাণ বিটুমিন দেওয়া হয় না বা বেশি দেওয়া হয়। এ ছাড়া সড়ক নির্মাণ ত্রুটির কারণে এই সমস্যা হতে পারে।’ এ জন্য সড়ক নির্মাণ ও বিটুমিন ব্যবহারে আরও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে অনুসরণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপপ্রবাহে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের পিচ গলে যাওয়ায়, এসব সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। এ ছাড়া তীব্র গরমে যশোর-নড়াইল সড়ক, যশোর-খুলনা মহাসড়ক, যশোর-ঝিনাইদহ ও যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে পিচ গলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
অন্যান্য জেলার মধ্যে গাজীপুর, শরীয়তপুর, বগুড়াসহ কয়েকটি জেলা সড়কের পিচ বা বিটুমিন গলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যশোর জেলার পিচ গলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এই জেলায় সড়কে যান চলাচলের সময় পিচে চাকা আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আবার কোথাও কোথাও যানবাহনের চাকার দাগ বসে গেছে সড়কে।
এ বিষয়ে গত সপ্তাহে শরীয়তপুরের প্রেমতলা বাস স্টেশনে কথা হয় ঢাকা-শরীয়তপুর রুটে মিল্টন নামে এক বাস চালকের সঙ্গে। শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস পরিবহনের এই চালক জনকণ্ঠকে জানান, ঈদের সময় ঢাকা-শরীয়তপুর রুটে যাতায়াতের সময় লাগত এক থেকে দেড় ঘণ্টা। এখন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে।
এই গরমের মধ্যে গাড়ি চালাতে সমস্যা হয়। কারণ গরমে রাস্তার পিচ নরম হয়ে যায়। এতে গাড়ির চাকা আটকে যায়। দুপুরের সময় তাপ বেশি হলে এই সমস্যা দেখা দেয়। নতুন সড়কে এই সমস্যা বেশি হয়। পদ্মা সেতু পর্যন্ত ঠিকমতো চলাচল করা যায়। কিন্তু যখন শরীয়তপুরের রাস্তা প্রবেশ করি, তখন গতি অর্ধেক কমিয়ে দিতে হয়। একদিকে দুই লেনের ছোট সড়ক তার ওপর তীব্র গরমে রাস্তার পিচ নরম হয়ে যায়।’ তাই ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে হয় বলে জানান তিনি।
এদিকে যশোর জেলার পিচ গলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে যশোর-নড়াইল মহাসড়কের নীলগঞ্জ, হামিদপুর, দায়তলা, ফতেপুর, তারাগঞ্জ এলাকায় সড়ক জুড়ে কালো পিচ গলে যেতে দেখা গেছে বলে স্থানীয়রা জানান। এ বিষয়ে ট্রাকচালক আবুল হোসেন নামের এক পণ্যবোঝাই ট্রাক চালক জানান, গত কয়েক দিনে আগে ট্রাকে পণ্য নিয়ে নড়াইল থেকে যশোর ফিরছিলেন।
কিন্তু রাস্তা এত গরম হয়েছে যে পথে ট্রাক থামিয়ে টায়ারে পানি স্প্রে করতে হয়েছে। ২৫ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য নিয়ে যাতায়াত করেছেন তিনি, কিন্তু এমনভাবে পিচ গলতে কখনো দেখেননি তিনি।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সড়ক-মহাসড়কের পিচ কালো হওয়ায় সূর্যের তাপ শোষণ করে বেশি।
যেসব সড়কে যানবাহন চলাচলের চাপ আছে, সেখানে চাকার ঘর্ষণে তাপ বেড়ে পিচ গলে যাচ্ছে। সাধারণত সড়ক-মহাসড়কে যে পিচ ব্যবহার করা হয় তার মান ৬০-৭০ গ্রেডের। এই পিচের গলনাঙ্ক ৪৮-৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে পিচ গলে যাওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েকদিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০-৪১ ডিগ্রি। এই তাপমাত্রায় পিচ গলে যাওয়ায় ব্যবহৃত পিচের মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন সওজ কর্মকর্তারা।