
ওপরে দুর্বার গতিতে ছুটে চলে মেট্রোরেল। নিচে সড়ক খানাখন্দে ভরা
ওপরে চলছে অত্যাধুনিক মেট্রোরেল। ঠিক নিচেই ভিন্ন চিত্র। যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হওয়া মেট্রোরেল এখন স্বস্তির বাহন। নগরবাসী দীর্ঘ যানজটের যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেয়েছে। নগরজীবনের আধুনিক বাহন হিসেবে মেট্রোরেল যতটাই প্রশংসিত-ঠিক ততটাই যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিচের মাত্র ৮শ’ মিটার রাস্তা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করছে এই রাস্তা দিয়ে। মেট্রোরেলের উত্তরা দক্ষিণ সেন্টার স্টেশন থেকে মিরপুর ডিওএইচএস গেট পর্যন্ত ছোট্ট রাস্তাটুকু যেন হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ।
ওপরে শো শো করে চলছে মেট্রোরেল। নিচের রাস্তায় মানুষের দুর্ভোগ। রাজধানীর বিশাল দুটি অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ রক্ষার একামাত্র এই রাস্তাটুকু পার হতে গিয়ে কারও গাড়ির চাকা ফাঁসছে, কারও গাড়ি উল্টে আহত হচ্ছেন কেউ। পিক আওয়ারে এক মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিতে লেগে যায় ৩০-৪০ মিনিট। এই রাস্তাটুকু নির্মাণ বা মেরামত করতে বৃহত্তর উত্তরা এবং মিরপুরবাসীর দাবি আমলেই নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন।
এই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী উত্তরা ও মিরপুরের বাসিন্দরা মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই রাস্তা হবে না। জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র আতিকুল ইসলাম দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আসলে এখানে রাস্তা করাই হয়নি। গত বছর প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেল উদ্বোধন করার প্রাক্কালে ওই রাস্তাটুকু সরু আকারে করা হয়েছিল। তারপর আর অগ্রগতি হয়নি। নানা জটিলতার মুখে পড়তে হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব রাস্তাটি নির্মাণ করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।’
আগে এই রাস্তাটি ছিল না। মেট্রোরেল করার সময় নিচ দিয়ে এই ৮শ’ মিটার রাস্তাটি তৈরি হয় ভাঙা ইট ও চলাচল দিয়ে। পরে এটি সংযুক্ত হয়ে যায় উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প এবং মিরপুরের সঙ্গে। ইট-খোয়ার রাস্তা দিয়েই চলতে শুরু করে বিপুলসংখ্যক গাড়ি। মিরপুরের সঙ্গে উত্তারার সহজ যোগাযোগের একামাত্র রাস্তাটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এটি ছাড়া মিরপুর ও উত্তরার মধ্যে আর কোনো বিকল্প সংযোগ সড়ক নেই। এই রাস্তা না হলে মিরপুর বা উত্তরার বাসিন্দাদের যাতায়াত করতে বিমানবন্দর-স্টাফ রোড হয়ে যেতে হয়। বিমানবন্দর বা উত্তরার দিকে রাস্তায় কোনো সমস্যা হলে ট্রাফিক বিভাগ থেকে যানবাহনকে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এটিই একমাত্র বিকল্প রাস্তা।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন।
এ উপলক্ষে রাতারাতি এই ৮শ’ মিটার রাস্তার একটি লেনে পিচঢালা করা হয়। এতে মিরপুর ও উত্তরাবাসীর মনে প্রশান্তি নেমে আসে। ধারণা করা হয়েছিল, খুব দ্রুতই মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে অন্য রাস্তাগুলোর মতোই আধুনিক একটি রাস্তা নির্মিত হবে। যাত্রীদের সেই প্রত্যাশা খুব দ্রুতই হতাশায় পরিণত হয়। ক্ষণস্থায়ী রাস্তাটি ভেঙে যায় খুব তাড়াতাড়ি। আবারও সেই খানাখন্দ। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ওপরে যতটা চাকচিক্য, নিচের চিত্র ঠিক তার বিপরীত। ভোগান্তি প্রতি মুহূর্তের। শুকনো সময় ধুলাবালি আর বৃষ্টির সময়ে খানাখন্দে যন্ত্রণা।
উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের বাসিন্দা হাসান বলেন, আমি নিয়মিত গাড়ি নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে মিরপুর ১ এক নম্বর গোলচত্বর যাই। প্রতিদিন এই রাস্তাটুকু পার হতে গিয়ে নানা বিপদে পড়তে হয়। রাস্তা ভাঙা, বড় বড় গর্ত হওয়াতে প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। যে ধরনের গাড়ি ব্যবহার করুক, কেউ নিস্তার পায় না। যিনি প্রাইভেট কার নিয়ে যান তিনিও সমস্যায় পড়েন। যিনি অটোরিক্সায় চলেন তিনিও ভোগেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো গাড়ি এখানে উল্টে পড়ে। যানজট তো আছেই।
তিনি বলেন, ওপরে চলে মেট্রোরেলের প্রশংসা। নিচে দুর্ভোগ আর বদনাম। অবস্থা যেন, ওপরে ফিটফাট নিচে সদরঘাট। এত দুর্নামের মুখেও কর্তৃপক্ষ এই রাস্তাটি মেরামত করছে না। সিটি করপোরেশন ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এ এলাকার লোকজনকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অথচ এখনই এটা ঠিক করা সময়। সামনে বৃষ্টির সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অথচ জনস্বার্থে এ রাস্তাটুকু নির্মাণ করে দিলে সবাই উপকৃত হতো। মেট্রোরেলের মতোই সুনাম ও ভাবমূর্তি বাড়ত সরকারের।
শহীদ মিয়া নামের দিয়াবাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, আমি প্রতিদিন এই রাস্তায় যাওয়া-আসা করি। দিয়াবাড়ি থেকে গাড়িতে করে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর যেতে সময় লাগে মাত্র বিশ মিনিট। অথচ মেট্রোরেল উত্তরা দক্ষিণ স্টেশন থেকে ডিওএইচএস পর্যন্ত মাত্র ৮শ’ মিটার রাস্তা পার হতে কোনো কোনো সময় ২৫ থেকে ৩৫ মিনিট লেগে যায়। এ রাস্তায় ছোট-বড় দুর্ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। বিশেষ করে বৃষ্টি হলে এই রাস্তায় সিএনজি-রিক্সা উল্টে যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে।
হামিদ নামে মিরপুর ডিওএইচএসের বাসিন্দা বলেন, আমি প্রতিদিনই এই রাস্তা দিয়ে দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসে যাই। সবটাই ভালো লাগে। শুধু ওইটুকু রাস্তা পার হতেই গলদঘর্ম হতে হয়। সারা রাস্তাজুড়ে ভাঙা গর্ত খানাখন্দ। তার ওপর আবর্জনার স্তূপ কোথাও কোথাও। কিছু অংশে আবার একদিকে গাড়ি চলতে পারে। কেউ গাড়ি চালান, কেউ থেমে থাকেন। যানজট এখানে সব সময়ই লেগে থাকে।
কেউ আবার মূল রাস্তা ছেড়ে পাশের কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে গর্তে পড়েন। রস্তার এমন বেহাল দশা দেখার কেউ নেই। করারও কোনো উদ্যোগ নেই। যার ফলে মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। আমি নিজেও কয়বার রিক্সা নিয়ে উল্টে পড়ে। তিনি রাস্তাটুকু নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান।
রাস্তাটুকু কবে নাগাদ মেরামত করা হবে কিংবা কেন এমন বেহাল দশা জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, রাস্তাটুকু নিয়ে নানা জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আসলে এটা আগে রাস্তা ছিল না। পরে বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশটি চালু উপলক্ষে জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হয়েছে। তারপর থেকে রাস্তাটুকু ব্যাপক ব্যবহার ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
উত্তরাবাসীও অন্য রাস্তার চেয়ে এখান দিয়েই মিরপুর থেকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। নানা জটিলতায় আর রাস্তাটুকু নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে যত দ্রুত সম্ভব রাস্তাটি নির্মান করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।