
মহান মুক্তিযুদ্ধে যশোরের মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনেক
মহান মুক্তিযুদ্ধে যশোরের মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনেক। পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর অত্যাচার-নির্যাতন শিকার করে তারা ৯ মাস চালিয়ে গেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধ। তাই তো দেশের প্রথম মুক্ত জেলা যশোর। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় যশোর জেলা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সব গৌরবগাঁথা স্মৃতি নিয়ে যশোরের নানা স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য। এছাড়া যশোর শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য। রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। অনেক জেলা শহরে এত ভাস্কর্য নেই। তাই যশোরকে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের শহরও বলা হয়।
যশোর চারুপীঠের অধ্যক্ষ মাহবুব জামাল শামীম জানান, অন্যান্য জেলা শহরের তুলনায় যশোরে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য বেশি। অনেক জেলা শহর আছে যেখানে এখনো মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য তৈরি হয়নি। সে তুলনায় যশোর ব্যতিক্রম। এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত শত্রুসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের পর এখানকার মানুষ সেই স্মৃতি ভুলতে পারেনি। সেটা ধরে রাখার জন্যই সব মানুষের প্রচেষ্টায় তৈরি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য।
বিজয়-৭১
উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে যশোর শহরে প্রবেশ করতে গেলেই চোখ পড়বে পালবাড়ি মোড়ে নির্মিত ‘বিজয়-৭১’ নামের ভাস্কর্যটি। সারাদেশের মধ্যে যশোর জেলা পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে প্রথম মুক্ত হয়। যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাকহানাদার বাহিনীর ঘাঁটি। সেই হিসেবে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে যশোর জেলা মুক্ত হওয়া একটি বিশাল বিজয় এবং গুরুত্ব বহন করে। ‘বিজয়-৭১’-এর মাধ্যমে সেই বিষয়টি দেখানো হয়েছে। বিজয়ের অনেক বছর পর নির্মাণ হলেও, স্মৃতির অমরতা প্রকাশ করা হয়েছে ভাস্কর্যে। বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে চলছেন মুক্তিযোদ্ধা।
শক্ত মুষ্টিতে পতাকার ঝা-া গভীর মমতায় বুকের সঙ্গে আলিঙ্গন। ডান কাঁধে তার ঝোলানো রাইফেল। তারই বাঁ পাশে রাইফেল হাতে আরেক মুক্তিযোদ্ধা। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা গর্বিত সেই যোদ্ধার চোখ আকাশপানে। পাশেই রাইফেল ও হেলমেট উঁচিয়ে উল্লসিত আরও দুই মুক্তিযোদ্ধা। তাদের একজনের খালি পা, পরনে লুঙ্গি। ত্রিভুজ আকৃতির বেদির ওপর ভাস্কর্যের আরেক দিকে দুহাতে শান্তির পায়রা উড়িয়ে যুদ্ধ শেষে আগামীদিনের শান্তির বার্তা আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন এক নারী। এই উল্লাসে তাদের সঙ্গে শরিকগুলোতে হাতে এক দুরন্ত কিশোরও। যশোরের এস এম সুলতান আর্ট কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম খন্দকার বদরুল আলম নান্নুর হাতের পরশে ভাস্কর্যটি এখনো ছড়াচ্ছে দীপ্তি।
বিজয় স্মৃতি
মনিহার সিনেমা হলের সামনে (পুরনো বাস টার্মিনাল এলাকা) ১৯৭৪ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে নাম না জানা শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় ‘বিজয় স্মৃতি’। পরে যশোরের জেলা প্রশাসক মহিউদ্দিন খান আলমগীর এর সংস্কার করেন। নড়াইল, রাজবাড়ী থেকে শ্বেতপাথর এনে এখানে ৫০ ফুট উঁচু স্তম্ভটি ১০ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত। ১৯৭৯ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগের এই জায়গাটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যশোর পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এখানে মোগল আমলের একটি কামান রয়েছে। এটি কেশবপুরের মীর্জানগর থেকে আনা হয়েছিল।
চেতনায় চিরঞ্জীব
যশোরসহ দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম বিদ্যাপীঠ যশোর মাইকেল মধুসূদন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (এমএম কলেজ)। দীর্ঘদিন ধরে যশোরবাসী ও ওই কলেজের ছাত্রদের চাওয়া ছিল সেখানে একটি ভাস্কর্য নির্মিত হোক। অবশেষে তা পূরণ হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ‘চেতনায় চিরঞ্জীব’ নামের ভাস্কর্য। এর শিল্পী যশোর চারুপীঠের অধ্যক্ষ মাহবুব জামাল শামীম বলেন, চেতনায় চিরঞ্জীব ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আগুনের শিখা। যে আগুন জ্বলেছিল ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, সমগ্র জাতির মধ্যে, বাঙালি জাতির মধ্যে।
এর শিলাবিন্যাস করেন এই কলেজের দুই অধ্যক্ষ প্রফেসর আফসার আলী ও প্রফেসর আবুল হোসেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই কলেজের দুই শিক্ষক গণিত বিভাগের নবীন চন্দ্র ঘোষ ও বাণিজ্য বিভাগের সিরাজ উদ্দীন আহমেদ শহীদ হন। এছাড়া ভাস্কর্যে নাম রয়েছে শহীদ ছাত্র মো. আসাদুজ্জামান, এসএম নজরুল ইসলাম, নিমাই চন্দ্র সাহা, আবু বকর সিদ্দিক, মফিজুর রহমান হেম ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর। তবে এই কলেজের আরও বেশ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন, তাদের নাম এখানে নেই।
উপশহর পার্কে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ
যশোর উপশহর পার্কে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ১৪ জনের নামের তালিকা রয়েছে। ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ এটির নির্মাণ করেন উপশহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেরুল হক সাবু।
জাগ্র্রত বাঙালি
যশোর শহরের পুরাতন কসবা ট্রাফিক আইল্যান্ডের পশ্চিম পাশে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। ভাস্কর্যের নাম ‘জাগ্রত বাঙালি’। এর শিল্পী হলেন রকিবুল ইসলাম শাহিন। এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে একটি সুন্দর নতুন স্বপ্ন। সে স্বপ্ন অবশ্যই স্বাধীনতার। সাদা কবুতর উড়িয়ে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে শান্তির কথা।
যশোর সিটি কলেজে স্মারক ভাস্কর্য
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে যশোর সিটি কলেজে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভাস্কর্যের নাম ‘চির উন্নত শির’। এটির নির্মাণ শিল্পী খন্দকার বদরুল ইসলাম।
অদম্য ১৯৭১
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য হচ্ছে ‘অদম্য ১৯৭১’। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ভাস্কর্যটি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) প্রশাসনিক ভবনের সম্মুখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কর্যটি শিল্পী মোজাই জীবন সফরি নির্মাণ করেন এবং ২০১৩ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের তথ্যমতে, ভাস্কর্যটির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরছেন।
ভাস্কর্যটির কম্পাউন্ডের দৈর্ঘ্য ২৬ ফুট। ২৬ ফুট কম্পাউন্ডের দৈর্ঘ্য দ্বারা মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চকে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া ভাস্কর্যটির বেদিসহ মোট উচ্চতা ২১ ফুট। ২১ ফুট দ্বারা মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারিকে বোঝানো হয়েছে। বেদিসহ দ-ায়মান ফিগারের উচ্চতা ১৬ ফুট। এর দ্বারা ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসকে বোঝানো হয়েছে।
মিত্র ও মুক্তিবাহিনী স্মৃতিস্তম্ভ
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন রাজাকারদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরায় নির্মাণ করা হয়েছে দেশের প্রথম মিত্র ও মুক্তিবাহিনী স্মৃতিস্তম্ভ। স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য ভারতীয় ৬ সেনার আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে।
স্মৃতিস্তম্ভটি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্ব গাথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
তবে, মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, ইতিহাস সংরক্ষণে দুই একটি অবকাঠামো নির্মাণ নয়, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সকল স্থানকে শনাক্ত করে প্রতীকী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।
দেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোর। এ জেলারই বাঘারপাড়া উপজেলার অন্তর্গত খাজুরা বাজার স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন রাজাকারদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকারদের সমন্বয়ে খাজুরা এন এম মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তখন স্থাপন করা হয়েছিল রাজাকার ক্যাম্প।
এর নেতৃত্বে ছিল ডা. ইব্রাহিম, ওই এলাকায় দ্বিতীয় টিক্কা খান নামে সমধিক পরিচিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, ডা. ইব্রাহিমের নেতৃত্বে পুরো খাজুরা অঞ্চলে কায়েম করা হয় ত্রাসের রাজত্ব। এ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ধরে এনে চালানো হতো নির্মম-পৈশাচিক নির্যাতন ও নিপীড়ন। এরপর তাদের ক্যাম্পের পেছনের চিত্রা নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার আগেই পরাজয় নিশ্চিত জেনে যশোর ক্যাম্প ছাড়তে শুরু করে পাকসেনারা। মিত্রবাহিনী ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত করে পাকসেনাদের পিছু নিয়ে পরেরদিন চলে যায় খাজুরায়। এ সময় তারা রাজাকার ডা. ইব্রাহিমের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে নিহত হন মিত্রবাহিনীর ভারতীয় ছয় সেনা সদস্য, আহত হন আরও একজন। যুদ্ধ শেষে নিহত ছয় সেনাকে ক্যাম্পের অদূরেই দাহ করা হয়।
তাদের সেই বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে দেশের প্রথম মিত্র ও মুক্তিবাহিনী স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গবেষক অধ্যাপক গোপীকান্ত সরকার বলেন, মিত্রবাহিনী যখন এনএম মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছায় তখন রাজাকাররা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করেন মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। একপর্যায়ে রাজাকাররা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ সময় মিত্রবাহিনীর সদস্যরা তাদের ‘জয় বাংলা’ বলে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। রাজাকাররা আত্মসমর্পণে রাজি হলে মিত্রবাহিনীর সাত সদস্য গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যান।
তবে তারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। রাজাকাররা এনএম মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংকার থেকে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে ছয় ভারতীয় সেনা নিহত হন। এছাড়া অপর এক সেনা আহত হন। তাদের মৃত্যুর খবর পেয়ে ব্যাকআপ বাহিনীর সদস্যরা এগিয়ে আসেন। এ সময় সেল নিক্ষেপ করে রাজাকার ক্যাম্পের একটি অংশ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এরপর কয়েকটি ট্যাংক এসে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে থাকা বাংকারগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। এতে মাটিচাপা পড়ে মারা যায় অনেক রাজাকার। আর যারা জীবিত ছিল, তাদের ধরে গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে কয়েকজন রাজাকার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
অধ্যাপক গোপীকান্ত সরকার আরও বলেন, কেবল মিত্রবাহিনীর সদস্যরা নয়, এ যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাঁথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে একটি প্রতীকী অবকাঠামোর প্রয়োজন ছিল। সেটিই স্থানীয় শহীদ মিত্র ও মুক্তিবাহিনী স্মৃতি পরিষদের দাবির প্রেক্ষিতে নির্মাণ হয়েছে।
সাজেদ রহমান, যশোর