মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শেষ হয়েছে মণিপুরী মহারাসমেলা
জেলার ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত সাংস্কৃতির ধারক মণিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ‘মণিপুরী রাসলীলা’ মঙ্গলবার সকালে শেষ হয়। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও পূর্ণিমা তিথিতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামণ্ডপ ও আদমপুর সানাঠাকুর মণ্ডপে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আর এ উৎসবকে সামনে রেখে পুরো মণিপুরী জাতি যেন জেগে উঠে নব উদ্যামে। তাদের ধারণা এ থেকে বিগতবছরের সকল গ্লানি দূর হয়ে একে অন্যের প্রতি জাগ্রত হয় প্রেম।
কথায় আছে ‘যে দেখেনি রাস মিটেনি তার মনের আস’ অর্থাৎ রাসলীলা দর্শনে মনের আশা পূর্ণ হয়। মনে জাগ্রত হয় কৃষ্ণ প্রেম। যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাস নিয়ে মণিপুরীরা তা পালন করে আসছেন। মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে তার মেয়ে চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে প্রথম শুরু করেছিলেন এ রাস লীলা। তাকে অনুসরণ করে ১৮৪২ সালে এ এলাকায় মণিপুরীরা কমলগঞ্জ মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে রাস লীলার আয়োজন করেন, যা বিগত ১৮১ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে।
কমলগঞ্জে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও রাখাল নৃত্যের মধ্য দিয়ে মণিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব পালন শুরু হয়েছে।
সোমবার বেলা ১২টার দিকে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে তুমুল হৈ চৈ, আনন্দ-উৎসাহে ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ধ্বনির মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখি রাধারলীলাকে ঘিরে পূর্ণিমা তিথিতে রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সোমবার দুপুরে ১২টায় মাধবপুর জোড়া ম-পে রাখাল নৃত্যের মাধ্যমে শুরু হয়ে মঙ্গলবার ঊষালগ্নে সাঙ্গ হলো মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা। মণিপুরী সম্প্রদায়ের এ বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসেছিল রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ঢল নামে।
মহারাসলীলা উপলক্ষে মাধবপুর ইউনিয়নের শিববাজার জোড়া ম-প ও আদমপুরে মহারাসলীলা দেখতে সারাদেশ থেকে আগত দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর মণিপুরী পাড়াগুলো। তবে অবরোধ থাকায় লোকসমাগম কিছুটা কম হয়েছে। এবার মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে ১৮১তম ও আদমপুরে মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের আয়োজনে ৪১তম রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার দুপুরে রাখাল নৃত্যের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে রাস উৎসব। রাস উৎসবে মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকসহ হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন।
রাত ১২টায় মাধবপুর জোড়া ম-পে অনুষ্ঠিত হয় রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে সমাগত হয়েছেন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠছে মাধবপুরের ম-প প্রাঙ্গণ। রাস উৎসবকে ঘিরে মাধবপুর ম-পগুলো সাজানো হয়েছে সাদা কাগজের নকশার নিপুণ কারুকাজে। করা হয়েছে আলোকসজ্জাও। এই উৎসব মণিপুরীদের সংস্কৃতির এক বিশাল মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।
রংবেরঙের পোশাক আর বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে উৎসবের জানান দিচ্ছে সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে। রাস উৎসব উপলক্ষে মাধবপুর শিববাজারে মণিপুরী তাঁতবস্ত্র প্রদর্শনী ও মেলা বসেছে। এ ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে উৎসব পালন করতে কাজ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সব ধরনের সুবিধা বিদ্যমান থাকায় এখানকার রাসলীলা বড় উৎসবে রূপ নিয়েছিল। উৎসবে যোগ দিতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী পর্যটক এসেছেন এখানে। সোমবার দুপুর ১২টা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কমলগঞ্জে হাজির হয়েছিল নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরসহ নানা পেশার হাজারও মানুষ। তাদের পদচারণায় সকাল থেকে মুখর হয়ে ওঠে কমলগঞ্জের আদমপুরের মণিপুরী পল্লী। মঙ্গলবার ঊষালগ্নে এ উৎসব শেষ হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া ম-প প্রাঙ্গণে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, আদমপুরের মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্সসহ আরও দুটি ম-প প্রাঙ্গণে মণিপুরী মৈতি সম্প্রদায়ের আয়োজনে হয়েছে মহারাসোৎসব।
রাস উৎসব ঘিরে প্রতিবারের মতো এবারও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। বসেছিল রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়।
মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, মাধবপুর জোড়াম-প রাসোৎসব সিলেট বিভাগের মধ্যে ব্যতিক্রমী আয়োজন। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার আগমন ঘটে। বর্ণময় শিল্পসমৃদ্ধ বিশ্বনন্দিত মণিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবে সবার মহামিলন ঘটে।
অপরদিকে রাসোৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে আদমপুর মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্র্রাঙ্গণে মৈতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের রাস উৎসবের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে আশ্বিন মাসের শেষ ভাগেই উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। উপজেলার মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে ওঠে একদিনের এ আনন্দ উৎসবে।
মাধবপুর মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, এবারে মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে ১৮১তম মহারাসলীলার অনুষ্ঠানে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় শুভেচ্ছা বিনিময় সভা ও প্রদীপ প্রজ্বালন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাত ১২টায় শুরু হয়। শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা, যা মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত চলে। প্রতিবছরের মতো এবারও মহারাসলীলা উপলক্ষে মাধবপুরের শিববাজারে বসেছে বিরাট মেলা।