পর্যটক আকর্ষণে বগুড়ার মহাস্থানগড়
চেনা পথের ধারে কত অজানা ইতিহাস। সভ্যতার পদধ্বনিতে মহাকালের প্রান্তরে ছুটে চলেছে ধসে যাওয়া প্রাচীন এক নগরী, যা আজকের মহাস্থানগড়। প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির রাজধানী পুন্ড্রনগর। পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারতে পুন্ড্র রাজ্যের উল্লেখ আছে। আড়াই হাজার বছর আগে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং পুন্ড্রবর্ধনের পথ ধরেন। ১৯ শতক থেকে এই মাটি খুঁড়ে পুরনো কথাগুলো বের করে আনছেন প্রতœতাত্ত্বিকগণ। গত শতকের ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথভাবে মহাস্থানগড়ে প্রত্ন খনন শুরু করে। প্রত্ন নিদর্শনে কয়েকটি কালের অস্তিত্ব মিলেছে। বের হয়ে আসে সভ্যতার সূচনালগ্নের ঐশ্বর্যের দীপ।
বগুড়ানগরী থেকে পাকা সড়ক ধরে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে জাতীয় মহাসড়কের ধারে দৃষ্টিতে আসে চওড়া প্রাচীর। যা দুর্গনগরীর বেষ্টনী। কথিত আছে এই প্রাচীরের ওপর দিয়ে পাশাপাশি সাতটি ঘোড়ায় চড়ে সৈন্যরা পাহারা দিত। যে শৌর্যগাঁথা বীরত্ব আজও শিহরিত করে। দেশের প্রাচীন এই নগরী দর্শনে বগুড়ায় আগমন ঘটে দেশী-বিদেশী পর্যটক। দেশজুড়ে পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের উন্মুক্ত করা হয়েছে। দেশে চারটি প্রতœতাত্ত্বিক স্থানে পর্যটন ও অবকাশ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এরমধ্যে একটি বগুড়ার মহাস্থানগড়। মহাস্থানগড়সহ কয়েকটি স্থানকে বিশ^ সম্পদের (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
পর্যটক আগমনে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের তরুণরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমেছে। বিশ্বের সকল মানুষকে মহাস্থানগড়কে চেনাতে নীরবে-নিভৃতে প্রচার চালাচ্ছে। তাদের এমন আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ বগুড়ার মহাস্থানগড়ে আসছেন। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের (বিপিসি) এক তথ্যে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে দেশে পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ৬৬৫ জন। ২০১২ সালে এই সংখ্যা ঠেকে ৫ লাখ ৮৯ হাজার। ২ হাজার ১৬ সালকে পর্যটন বছর ঘোষণার পর্যটক আগমনে টার্গেট ধরা হয় ৭ লাখ। এর বড় একটি অংশ এসেছিলেন মহাস্থানগড়। যে সংখ্যা অন্তত আড়াই লাখ। করোনাকালে পর্যটক আগমনে ভাটা পড়ে। ২০২২ সাল থেকে পর্যটক আগমন বেড়েছে। দেশে যে সংখ্যা বছরে অন্তত ১০ লাখ। এর একটি অংশ আসছে মহাস্থানগড়। এই সংখ্যা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে মহাস্থানগড়ের যোগাযোগ ও আবাসন ব্যবস্থা আরও উন্নত হলে পর্যটক আগমনের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনটি মনে করেন বগুড়ার কয়েকটি উন্নত আবাসিক হোটেল কর্তৃপক্ষ। যার তিনটি পাঁচ তারকা খচিত। সুধীজন বলেন একই কথা। ঢাকা থেকে বগুড়ার দূরত্ব সড়কপথে ২০৭ কিলোমিটার। সেখান থেকে আরও প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে মহাস্থানগড়। বাসে ঢাকা থেকে বগুড়া পৌঁছাতে সময় নেয় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। নিজস্ব গাড়িতে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা। মহাস্থানগড়ে পর্যটকদের থাকার ভালো আবাসন ব্যবস্থা নেই। যে কারণে পর্যটকদের বগুড়া শহরে থেকে মহাস্থানগড় ঘুরে আসতে হয়।
প্রাচীন নগরী মহাস্থানগড় ও সেখান থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ভাসুবিহার দেখতে এবং ইতিহাস জানতে কোনো গাইড নেই। নিজস্ব গাড়ি না থাকলে পাকা সড়ক পথে গাড়ি রেন্ট করে যাওয়া যায়। কার রেন্টে একদিনের জন্য দুই থেকে তিন হাজার টাকা। মাইক্রোবাস একদিনের রেন্টে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। দূরপাল্লার বাস সার্ভিসে মহাস্থানগড় স্টপেজ আছে। অটোরিকশা আছে। রেলপথে সরাসরি যোগাযোগ নেই। বগুড়ায় বিমানবন্দর আছে তবে তা সিভিল অ্যাভিয়েশনের অধীনে নয়। যে কারণে সাধারণের উড়াল পথ নেই। হালে বগুড়ার পাঁচতারকা খঁচিত একটি হোটেল কর্তৃপক্ষ হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু করেছে। জনপ্রতি নয় হাজার টাকায় তারা একমুখী উড়াল দেয়। বগুড়ার মহাস্থানগড়কে ঘিরে আরও নতুন ইতিহাস উদ্ঘাটিত হয়েছে। খনন কাজে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা পরশুরাম প্যালেসের অস্তিত্ব মিলেছে।
প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায় মৌর্য সুঙ্গ গুপ্ত পাল সেন শশাঙ্ক মুসলিম মুঘল ব্রিটিশ সভ্যতার বহু চিহ্ন উঁকি দিয়ে আছে মহাস্থানগড়ে। ভাসুবিহারের প্রতœ খননে তিনটি বৌদ্ধ মন্দির একটি, উচ্চ শিক্ষায়তন মিলেছে। এক সূত্র জানায়Ñ ভারতীয় পর্যটকদের যাতায়াত বাড়ছে। ভারতের সেভেন সিস্টারখ্যাত ৭টি প্রদেশেও পর্যটক আকর্ষণ করে। সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতায় দেশের প্রাচীন ইতিহাসখ্যাত স্থানগুলোকে পর্যটকবান্ধব কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে পর্যটকদের জন্য অবকাশ কেন্দ্র হোটেল বাংলো কটেজ এখনো নির্মিত হয়নি।
মহাস্থানগড়ে পর্যটকদের খাবারের ভালো হোটেল নেই। তবে পথের ধারে যে হোটেলগুলো আছে যেখানে খাবারের মান ভালো ও সুস্বাদের। দাম সাধ্যের মধ্যে। মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্যের মিষ্টান্ন ‘কটকটি’। পর্যটকগণ যেমন বগুড়া থেকে দই কেনেন তেমনি মহাস্থানগড় থেকে কটকটি কিনতে ভোলেন না।
সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস