ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

ফসলি জমিতে সিসা কারখানা, হুমকির মুখে জীব-বৈচিত্র্য

এন কে বি নয়ন, বোয়ালমারী, ফরিদপুর 

প্রকাশিত: ১৩:১৪, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩; আপডেট: ১৩:২০, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ফসলি জমিতে সিসা কারখানা, হুমকির মুখে জীব-বৈচিত্র্য

সিসা কারখানা

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার বিল দাদুড়িয়া এলাকায় ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে অবৈধ সিসা কারখানা। এতে পরিবেশ ও বিভিন্ন ফসল বিপর্যস্তর পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য। বিলের চারিপাশের কলারন, রাজাপুর, বিশ্বাসপুর, পায়োইলসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। এদিকে, প্রায় নয় মাস ধরে চলা সিসা কারখানাটির নেই কোন পরিবেশ ছাড়পত্র। 

আরও পড়ুন :জনপ্রিয়তায় বাইডেনকে ছাড়িয়ে গেলেন ট্রাম্প

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার চতুল ইউনিয়নের কলারণ ও বিশ্বাসপুর গ্রামের মাঝামাঝি দাদুরিয়া বিল। বিলের ফসলি জমিতে বোয়ালমারী-ময়েনদিয়া সড়কের পাশে এ সিসা কারখানাটি অবস্থিত। কারখানার চারদিকে প্রাচীরে ঘেরা, সামনে লোহার গেট। নেই কোন সাইনবোর্ড। সরেজমিনে দেখা যায়, সিসা কারখানাটিতে দিনের বেলায় কোন কাজকর্ম করা হয় না। দিনভর অনেকটা শুনশান নীরবতা। মূলতঃ গভীর রাতে চলে কারখানার কার্যক্রম। রাত হলেই জ্বলে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাটারি পোড়ানোর এসিডের তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ। ব্যাটারি পোড়ানোর জন্য চিমনি ছাড়া শুধু তিনটি চুল্লি রয়েছে। চুল্লিতে আগুন জ্বালিয়ে তার ভিতরে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয়। সিসা কারখানায় বিভিন্ন স্থান থেকে আনা পুরাতন ব্যাটারির প্লেট,প্লাস্টিকসহ অন্যান্য জিনসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এখানে ১৮ জন শ্রমিক সিসা গলানোর কাজে নিয়োজিত। ব্যাটারি পোড়ানোর চুল্লির উপর দিয়ে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুতের লাইন টাঙানা রয়েছে। 

এতে করে চুল্লির আগুন ও বিদ্যুতের ক্যাবল আগুন লেগে যে কোন সময়ে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। অবৈধ এ সিসা কারখানার পাশেই রয়েছে এম এইচ গোল্ডেন জুট মিল। সিসা কারখানার কারণে পথচারী ও জুট মিলের শ্রমিকরা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝঁকিতে রয়েছে।

এ ব্যাপারে বিশ্বাসপুর গ্রামের আফসার শেখ বলেন, সিসা তৈরির কারখানাটির কোন অনুমোদন নেই। কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করছে। সিসা কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া আর বর্জের কারণে মাছ,গবাদি পশু ও অন্তত ৫ থেকে ৬টি গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। মাঠের ফসলি জমির ধান ও বিভিন্ন ধরনের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। 

একই গ্রামের আরেক বাসিন্দা অচিন্ত বিশ্বাস বলেন, দাদুড়িয়া বিলটি  বিলের এ পাশের পানিতে মাছ নেই। তাই জেলেরা দক্ষিণ পাশে বিলের মাঝে গিয়ে মাছ ধরছেন। তিনি এ সিসা কারখানা বন্ধ করার জোর দাবি জানান।

পার্শ্ববর্তী রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা হৃদয় মানবতা গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী শাহাদুজ্জামান লিটন জনকণ্ঠকে বলেন, দাদুড়িয়া বিলটি কৃষি ফসল ও মাছে জন্য বিখ্যাত। উপজেলা সদরের ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ এই বিলের মাছ ও ফসলের উপর সারা বছর নির্ভরশীল। অবৈধ সিসা কারখানার কারনে কৃষি ফসল,মাছ,পশু-পাখি ও মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অবৈধ কারখানাটি দ্রুত সময়ের মধ্যে অপসারণ করা হোক।

সিসা কারখানার ম্যানেজার আলমগীর হোসেন বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে নষ্ট ও বাতিল ব্যাটারি কিনে আনা হয়। সে ব্যাটারিগুলো কারখানায় এনে ব্যাটারির বিভিন্ন অংশ খুলে আলাদা করে সিসা তৈরি করতে পোড়ানো হয়। এতে শ্রমিকদের কোন ক্ষতি হয় না। তারা অনেক বছর ধরে এ কাজ করে আসছে।

এ ব্যাপারে সিসা কারখানার মালিক সামচুল আলম বলেন, প্রায় এক বছর ধরে কারখানাটি চালু করা হয়েছে। ৫ বছরের চুক্তিতে জায়গা লিজ নিয়ে মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় ওই কারখানায় সিসা তৈরির কাজ করা হয়। কারখানাটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। দেশে শত শত সিসা কারখানা চলছে। সিসা কারখানায় পরিবেশের কোন ক্ষতি নেই বলে তিনি দাবি করেন। বগুড়া থেকে আসা অভিজ্ঞ শ্রমিকরা কাজ করে। ১০ থেকে ২০ বছর ধরে এ সকল শ্রমিকরা কাজ করে আসছেন তাদেরতো কোন সমস্যা হচ্ছে না। 

তিনি আরও বলেন, খুলনার হ্যামকো কোম্পানি আমাদের পুরাতন ব্যাটারি দেয়। সেই পুরাতন ব্যাটারি প্রোসেস করে সিসা তৈরি করে ওই কোম্পানিকে দেওয়া হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এম এম নাহিদ আল রাকিব বলেন, সিসা তৈরির কারখানা মানবদেহ, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও হুমকি। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। আর কারখানায় যে সকল শ্রমিকদেরও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। 

এ বিষয়ে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারেফ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, সিসা কারখানাটির বিষয়ে কিছুই জানা নেই। আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। তবে এলাকাবাসী লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে সহজ হবে। তারপরও দ্রুত খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাইদ আনোয়ার বলেন, সিসা কারখানা পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। বোয়ালমারীতে এমন সিসা কারখানা আছে জানা নেই। সিসা কারখানাটির কোন ছাড়পত্র নেই। এমন কি পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদনও করেনি। আর আবেদন করলেও এসব কারখানার অনুমোদন দেওয়া হয় না। এ বিষয়ে দ্রুত খোঁজ-খবর নিয়ে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ওই সিসা কারখানা ভেঙে দেওয়া হবে।

এসআর

×