রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে জয়কালী মন্দির এলাকায় রিক্সা ও বিভিন্ন যানবাহন রাখা হয়েছে
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার নিচের অংশে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সাড়ে ১১ কিলোমিটার ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের বেশিরভাগ অংশ বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এর ফলে ছোট হয়ে গেছে নিচের সড়ক। বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা অংশকে মিডিয়ান বলা হয়। মিডিয়ানের ভেতরে রিক্সা, ভ্যান ও গাড়ির গ্যারেজ, পাবলিক টয়লেট, দোকানপাট, পরিচ্ছন্ন কর্মীদের আবাসস্থল, ঘোড়ার আস্তাবল, পুলিশ বক্স ও বিভিন্ন পণ্যের গুদাম ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে ডাস্টবিন বানিয়ে রাখা হয়েছে ফ্লাইওভারে নিচের মিডিয়ানে। ময়লার দুর্গন্ধের কারণে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করা অনেক সমস্যা হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
সরেজমিনে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, ফ্লাইওভারের মিডিয়ানের কারণে নিচের সড়ক ছোট হয়ে গেছে। আট লেনের সড়কের বেশিরভাগ অংশ বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। তাই আট লেনের সড়ক এখন চার লেনে পরিণত হয়েছে। সাড়ে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারটি ঢাকা-কাঁচপুরের মহাসড়কের শনিরআখড়া থেকে গুলিস্তান হয়ে পুরান ঢাকার চানখাঁরপুলে শেষ হয়েছে। ফ্লাইওভারের নিচের পুরো অংশ এলোমেলো ভাবে পড়ে রয়েছে। ফ্লাইওভারের নিচের মিডিয়ানগুলো স্থান ভেদে সাড়ে তিন মিটার থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত চওড়া। মিডিয়ানের ওপর নানা অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
চানখাঁরপুল এলাকায় মিডিয়ানের ওপর রাখা হয়েছে ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়া, বিভিন্ন দোকানের মালামাল। বঙ্গবাজার থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত অংশে মিডিয়ানজুড়ে খাবারের দোকান। ফুলবাড়িয়া থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত অংশে মিডিয়ানজুড়ে বসানো হয়েছে অস্থায়ী জুতার দোকান। মিডিয়ানের কারণে ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান।
এ বিষয়ে খোরশেদ আলম নামের আলাউদ্দীন রোডের এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নগর ভবনের পাশ দিয়েই ফ্লাইওভারের এই অংশটি অতিক্রম করেছে। কিন্তু ফ্লাইওভারের ওপরে ফিটফাট থাকলেও নিচের অবস্থা খুবেই খারাপ। সড়কের অর্ধেকের বেশি জায়গা বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। যার দরুন সড়ক ছোট হয়েছে। তাই ফ্লাইওভারের নিচের সড়কে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। এ ছাড়া বাউন্ডারি ঘেরা জায়গায় ঘোড়া পালন থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা করা হয় না। ময়লা-আবর্জনা ফেলে নোংরা করে রাখা হয়েছে ফ্লাইওভারের নিচের অংশ।’
১০ বছরেও হয়নি মিডিয়ানের সৌন্দর্য ॥ দশ বছরেও হয়নি যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার নিচের মিডিয়ানের (ফাঁকা জায়গা) সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ। ২০১৪ সালের মে মাসে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের সাড়ে ১১ কিলোমিটার নির্মাণকাজ শেষ হয়। এর আগে ২০১৩ সাল অক্টোবর মাস থেকেই শনিরআখড়া-গুলিস্তান পর্যন্ত ফ্লাইওভারটির এ অংশ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু এতদিন পরেও ফ্লাইওভারের নিচে বাউন্ডারি ঘেরা মিডিয়ান অংশে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।
মিডিয়ান অংশের বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে ডাস্টবিনের মতো বানিয়ে রাখা হয়েছে। এতে মশা উৎপাদন ও দুর্গন্ধ সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের নিচে একাধিক স্থানে ময়লা রাখার জন্য এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন) নির্মাণ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ সব এসটিএসর ডাস্টবিনের ময়লা পচা দুর্গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তাই ময়লার দুর্গন্ধের কারণে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করা অনেক সমস্যা হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
এ বিষয়ে মিজানুর রহমান নামের যাত্রাবাড়ী এলাকার এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারে কারণে নিচের রাস্তা সরু হয়ে গেছে। এ ছাড়া বাউন্ডারি দেওয়ার কারণে রাস্তা পারাপার হতে সমস্যা হয়। পাশাপাশি বাউন্ডারি দেওয়া অংশগুলো রাখা হয়েছে এলোমেলোভাবে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে নোংরা করে রাখা হয়েছে। ফ্লাইওভারের উপরে পরিপাটি করে রাখলেও নিচের অবস্থা খুবেই খারাপ করে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা আরও ময়লা রাখার ঘর বানিয়েছে ফ্লাইওভারের নিচে। তাই ফ্লাইওভারের নিচে এখান মাদকসেবী ও ভবঘুরের স্থানে পরিণত হয়েছে বলে জানান তিনি।
ফ্লাইওভারটির র্যাম্প নামানো হয়েছে রাজধানীর টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে ১টি, জনপদ মোড়ে ১টি, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড ২টি, জনপদ সড়কের গোলাপবাগ মাঠের কাছে ১টি এবং সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের ভেতরে ১টি, দোলাইরপাড়-পোস্তগোলা সড়কে ২টি, ডেমরা সড়কে ১টি করে। তবে এসব র্যাম্পের কারণে রাস্তা সরু হয়ে গেছে। এ ছাড়া এসব র্যাম্পে নিচের সড়কে ও ফ্লাইওভারের পিলারে চারপাশে বাউন্ডারি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। বাউন্ডারি ঘেরা এই অংশগুলোকে মিডিয়ান বলে। এখানে মাটি ফেলে ভরাট করে সৌন্দর্য বর্ধনের কথা ছিল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু ১০ বছর হয়ে গেলেও এখনো সৌন্দর্য বর্ধনের কোনো কাজ করেনি ওরিয়ন গ্রুপ। ময়লা-আবর্জনা ফেলে ডাস্টবিন বানিয়ে রাখা হয়েছে নিচের মিডিয়ান। ময়লার দুর্গন্ধের কারণে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করা অনেক সমস্যা হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ॥ প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের নিচের অংশে বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করেছে বেসরকারি কোম্পানি। তারা যেহেতু উপরের সড়কে টোল আদায় করছে। তাই নিচের সড়ক যাতে খারাপ থাকে এটা তারা চাইবে। যাতে করে সব গাড়ি উপর দিয়ে যাতায়াত করে। এতে টোল আদায় বেশি হবে। নিচের সড়কের দায়িত্ব সিটি প্রশাসনের। জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করতে হলে নিচের সড়ক ভালো রাখতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তা আদায় করতে পারেনি।
নিচের সড়কের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করার কথা ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। তা তারা করেনি। উল্টা ফ্লাইওভার থেকে বৃষ্টির পানি ফালানো হচ্ছে নিচের সড়কে। এতে সড়কে তৈরি হচ্ছে বড় গর্ত। এটা কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে না। পাইপের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সরাসরি ড্রেনের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে পারত। কিন্তু তারা মিডিয়ানের মধ্যে বৃষ্টির পানি জমা করছে। তা এসে পড়ছে সড়কে। এতে স্থানীয়দের চলাচলের দুর্ভোগ বাড়ছে। তাই আমি বলব সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে ফ্লাইওভারের নিচে এই বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের সঙ্গের জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান তিনি। অথচ যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় প্রকল্প পরিচালক ছিলেন এই প্রকৌশলী।