জেলার সবচেয়ে বেশি চা বাগান মৌলভীবাজার-৪ আসনে
জেলার সবচেয়ে বেশি চা বাগান মৌলভীবাজার-৪ আসনে। পর্যটনের রাজধানী হিসেবে পরিচিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ রূপমাধুর্য সমতলভূমি, উঁচু-নিচু অসংখ্য টিলা ও পাহাড়। রয়েছে মনোরম সারি সারি চা বাগান, রাবার বাগান। লেবু, আনারস, কাঁঠাল ও নাগা মরিচের বাগান। তেল, গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদেও ভরপুর। রয়েছে মনিপুরী, খাসিয়া, গারোসহ অনেক নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হামহাম জলপ্রপাত, নয়নাভিরাম চা বাগান, হাইল হাওড়ের বাইক্কা বিল, শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা-গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাতগাঁওয়ের চা-কন্যা মনুম্যান্ট, শ্রীমঙ্গলে সাত রংয়ের চাসহ অসংখ্য নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য।
মৌলভীবাজার-৪ আসন শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার দুইটি পৌরসভা ও শ্রীমঙ্গলের ৯টি ইউনিয়ন, কমলগঞ্জের ৫টি ইউনিয়ন মিলে ১৪ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ নির্বাচনী আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৮৩০ জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৯ হাজার ৭৪২ জন। নারী ভোটার ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৮ জন।
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে মোহাম্মদ ইলিয়াস বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। এ নির্বাচনে আহাদ মিয়া জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম নির্বাচনে আব্দুস শহীদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ১১ দিন মেয়াদি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে শফিকুর রহমান বিএনপি থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০১৮ সালের শেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত একটানা পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুস শহীদ, যিনি এলাকায় উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ নামেই সর্বাধিক পরিচিত।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার দেন। সেই থেকে চা শ্রমিকদের নৌকা মার্কার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। মৌলভীবাজার জেলার সবচেয়ে বেশি চা বাগান অধ্যুষিত এই আসনে যে কোনো প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় চা শ্রমিকদের ভোটে। এ আসনটিকে আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবেও পরিচিত। দেশ স্বাধীনের পর প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- এই আসন থেকে ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক প্রধান হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, সাবেক এআইজিপি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ বজলুল করিম, কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক জিপি অ্যাডভোকেট আজাদুর রহমান আজাদ, মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সৈয়দ মনসুরুল হক, শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. হরিপদ, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক নবারুন দাশ রিপন।
অন্যদিকে, বিএনপির প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শুনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি হাজী মুজিবুর রহমান চৌধুরী, হাজী মুজিব এবং শ্রীমঙ্গল পৌরসভার পৌর মেয়র মহসীন মিয়া মধু উল্লেখযোগ্য।
এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সর্বাধিক ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, সাবেক প্রধান হুইপ মিষ্টভাষী বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ড. আবদুস শহীদ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য থাকায় তার পক্ষে-বিপক্ষেও নানা জনমত রয়েছে। আগামী নির্বাচনেও তিনি এই আসনে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থী।
আগামী নির্বাচন নিয়ে জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ বলেন, আগামীতে নির্বাচিত হলে প্রথমে কমলগঞ্জে একটি সরকারি মেডিক্যাল করতে চাই। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক জায়গা রয়েছে। যদি একটি মেডিক্যাল করা হয় তাহলে আর জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে না। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজঘাট ইউনিয়নের বার্মাছড়া চা বাগানের ভেতর একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ ধরনের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সিলেট বিভাগের মধ্যে একমাত্র এটি।
তিনি বলেন, কমলগঞ্জ হাসপাতালে অক্সিজেন প্লান্ট করেছি এবং ইতোমধ্যেই এটি চালু হয়েছে। এ ধরনের অক্সিজেন প্লান্ট সিলেট বিভাগের মধ্যে একমাত্র কমলগঞ্জে রয়েছে। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে পর্যটক আমাদের এখানে বেড়াতে আসেন। এখানে রয়েছে প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এই লাউয়াছড়া কেন্দ্রিক যতগুলো ছোট ছোট সড়ক ছিল সবই পাকা করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গল কমলগঞ্জে পর্যটকদের রাত্রি যাপনের জন্য ছোট বড় অনেক রিসোর্ট রয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মরণী, মাধবপুরে মাধবপুর লেইক, হামহাম জলপ্রপাত রয়েছে। হামহামে পর্যটকরা যাওয়ার জন্য রাস্তা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ বাইক্কা বিল। সেখানে রাস্তা-ঘাট ছিল না। সেখানে রাস্তাঘাট করা হয়েছে। এই বাইক্কা বিলে যে কেউ ইচ্ছে করলে মালদ্বীপের মতো ওয়াটার রিসোর্ট করতে পারে। নিজের অর্থায়নে শ্রীমঙ্গলে উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ কলেজ নির্মাণসহ নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা-ের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন ছয়বারের নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য।
অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী কমলগঞ্জ উপজেলার তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, এই অঞ্চল স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের তিনটি দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের এলাকা মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন। তাদের থাকা খাওয়াসহ সকল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। হামহাম জলপ্রপাতের যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন করতে হবে। চা শ্রমিকদের মান উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে কাজ করতে হবে। চা শ্রমিকদের সন্তানের লেখাপড়ার জন্য প্রাইমারি স্কুল নির্মাণ এবং স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য আরও কাজ করতে হবে। যদি আমি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হই তাহলে এ কাজগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করব।
মনোনয়নপ্রত্যাশী কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং আইনজীবী সমিতিতে একাধিকবার নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজাদুর রহমান আজাদ বলেন, আমি যদি নির্বাচিত হই প্রথমে আমি আত্মীয়করণের বলয় থেকে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জবাসীকে বাহিরে নিয়ে আসব। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ, ঈদগাহ করেছি। কমলগঞ্জে অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এই জাতীয় উদ্যানকে কেন্দ্র করে মৌলভীবাজারের পর্যটন শিল্প। এই লাউড়াছড়ার কারণে আমাদের পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়েছে। তবে আত্মীয়করণের মাধ্যমে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রায় ১১ বছর ধরে কোনো পরিচালনা কমিটি নেই। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রাণিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে লাউয়াছড়া এলাকায় ট্রেন পথে ও সড়কপথে ফ্লাইওভার নির্মাণ করব যাতে বন্যপ্রাণী নির্বিঘেœ ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করতে পারে। এতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সৈয়দ মনসুরুল হক বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইব। শ্রীমঙ্গল কমলগঞ্জ উপজেলার দীর্ঘদিনের দাবি একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ। প্রস্তাবিত শেখ রাসেল উদ্যান যেখানে আমরা বিজয় মেলা ও বৈশাখী মেলার আয়োজন করতে পারব। শ্রীমঙ্গলবাসীর দুর্ভোগ এবং দীর্ঘদিনের দাবি ড্রাম্পিং স্টেশন স্থাপন। শ্রীমঙ্গল শহর ভৌগলিকভাবে জলাবব্ধতা নিরসনের উপযুক্ত স্থান হলেও সামান্য বৃষ্টি হলেই শহর পানির নিচে তলিয়ে যায়। এই জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এভাবে অনেক বড় বড় সমস্যা রয়েই গেছে।
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক নবারুন দাশ রিপন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের পর এখন যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য যে ঘোষণা দিয়েছেন, আমি মনে করি আমার মতো অপেক্ষাকৃত কম বয়সী তরুণরাই এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারবেন। বর্তমান ভোটারের এক চতুর্থাংশ যুবক, যাদের বয়স ২৫ এর নিচে। স্মার্ট বাংলাদেশ বানাতে হলে স্মার্ট তরুণ যুবকের প্রয়োজন। আমি মনে করি এই তরুণদের স্মার্ট বানাতে আমি একটি ভূমিকা পালন করতে পারব।
অন্যদিকে, বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি হাজী মুজিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমি দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব, অন্য কোনোভাবে নয়। আমাদের দল এখন আন্দেলনে আছে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং সেই নির্বাচনে আমি মনোনয়ন পেলে নির্বাচনী ইশতেহার দেব এবং সেই ইশতেহারে সকল ঘোষণা থাকবে।