ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বিবিধ খেলা, বিচিত্র আনন্দ

-

প্রকাশিত: ০১:৪৫, ৯ জুন ২০২৩

বিবিধ খেলা, বিচিত্র আনন্দ

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সেই স্মৃতিময় খেরাধুল

শৈশব শব্দটি শুনলেই কেমন যেন একটা কল্পনার জগৎ চলে আসে চোখের পাতায়। আমাদের গ্রাম-বাংলার শৈশব যেন দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার নিত্যদিনের খেলাধুলাগুলো। এখন সেসব খেলার কথা মনে হলে মনে পড়ে যায় খেলার সাথীদের কথা। মনে পড়ে যায় শৈশবের হারিয়ে যাওয়া খেলা আর স্মৃতির কথা। 
শিশু মানেই দৌড়ঝাঁপ, কোলাহল আর চঞ্চলতা। তারা অবসরে গ্রামের খোলা মাঠে দল বেঁধে খেলত গ্রামীণ নানান খেলা। আর খেলাধুলার মাধ্যমে শৈশবে দুরন্তপনায় জড়িয়ে থাকত শিশু-কিশোররা। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের বেড়ে ওঠা সোনালি শৈশব যেন কতদিন আগেই হারিয়ে গেছে। শুধু চর্চার অভাবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা। গ্রামীণ কৃষ্টি ও লোকজ ক্রীড়াঙ্গনের জনপ্রিয় এ খেলাগুলো চর্চার নেই কোনো উদ্যোগ। 
কালের বিবর্তনে গ্রামীণ খেলাগুলো হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের চিত্রও। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সময় হয়ে উঠেছে অনেকটাই যান্ত্রিক। বদলে গেছে আমাদের চারপাশের বিনোদনের মাধ্যম। মোবাইল গেমসের কারণে এখন আর বিকালবেলা মাঠে দেখা যায় না কাউকে। তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় শিশু-কিশোররাও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে না। তাই বিলুপ্ত হতে চলেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলা।

তবে এখনো কিছু কিছু খেলা চোখে পড়ে। গ্রামাঞ্চলে একসময় শতাধিক গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচলন ছিল। সেগুলো হচ্ছে-দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, কানামাছি, বউচি, পাইক্কা, কপালটোকা, এক্কাদোক্কা, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, কুমির কুমির খেলা, মোরগ লড়াই, লুকোচুরি, পুতুল খেলা, মার্বেল খেলা, রান্নাবাটিহ অন্যান্য খেলাধুলা। একসময় রেডিও আর গ্রামীণ খেলাধুলাই ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। শুধু কি তাই, এসব খেলার জন্য গ্রামাঞ্চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। বর্তমানে এসব খেলাধুলার প্রচলন না থাকায় গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য। তবে এখনো নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়াদৌড়, হা-ডু-ডু, কাবাডিসহ হাতেগোনা কয়েকটি খেলার প্রচলন আছে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ ও গ্রামীণ মেলার সময় এসব খেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, শহরাঞ্চলে তো বটেই বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে অনেক খেলা হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ একসময় গ্রামের শিশু-কিশোররা পড়াশোনার পাশাপাশি মেতে উঠত বিভিন্ন ধরনের খেলায়। বিকেলে খোলা মাঠে দস্যিপনা চালাত শিশু-কিশোররা। যুবক কিংবা শিশু-কিশোররা দল বেঁধে খেলত হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, কাবাডি, ক্রিকেট ও ফুটবল। শৈশবের দুরন্তপনা ও খেলাধুলায় মেতে থাকত ছেলে-মেয়ের দল। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে অতীতের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাকে। ফলে ভিডিও গেম, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মোবাইল আসক্তির নেশা আজ শিশু-কিশোর-যুবকদের ঠেলে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর মাদকতার দিকে। 
নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রামীণ খেলাধুলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা চিনে না বলে জানায়। তাদের কাছে, পড়াশোনার চাপ খুব বেশি যার কারণে এখন খেলার সময় পায় না বলে শিক্ষার্থীরা জানায়। এমনকি ছুটির দিনেও সময় পায় না। যে কারণে এখন মাঠে-ঘাটে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা করতে দেখা যায় না। তবে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলার প্রতি মনোযোগ থাকলেও অন্য খেলায় তাদের তেমন আগ্রহ নেই।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য নূর আজিজ আহমেদ খান বাবু জানান, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের কাছে আজ গ্রামীণ খেলাধুলা অনেকটাই নতুন। তারা এখন মাদক ও কিশোর গ্যাং-এ বিপথগামী হচ্ছে। আর এ জন্য দায়ী স্থানীয়ভাবে কতিপয় রাজনৈতিক কিছু নেতা। এ থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্রীড়া সংগঠনগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
মাধ্যমিকের শিক্ষক ও কবি আমিনুল ইসলাম সেলিম বলেন, এখন মানুষের সময় নেই। গ্রামীণ খেলা আয়োজন করবে এমন উদ্যোগ নেওয়ার মানুষও নেই। ইনডোর গেম বেড়ে গেছে। মানুষ মোবাইল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হচ্ছে। তাই গ্রামীণ খেলা হারিয়ে যাচ্ছে। কিশোরগঞ্জ যুব উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আমিনুল হক সাদী বলেন, বেকার তরুণ-তরুণীরা কর্মক্ষম না থাকায় তারা তথ্যপ্রযুক্তিতে আসক্তি হয়ে বিপথগামী হচ্ছে। তারা খেলাধুলার প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাই তাদেরকে খেলাধুলায় মনোযোগী করতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, পড়াশোনা যেমন ছেলে-মেয়েদের মানসিক বিকাশ ঘটায়, তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। আগেকার দিনে প্রতিবছর সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। এখন সেটিও সর্বক্ষেত্রে প্রতিপালন করতে দেখা যায় না। অথচ খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু-কিশোররা যোগ্য নাগরিকের গুণাবলী, দলীয় শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব প্রদান, বিজয় লাভের উপায় এবং পরাজয়ে ভেঙ্গে না পড়া সম্পর্কে শিখতে পারে। আত্মবিশ্বাসী আর শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো খেলার মাঠ নেই। ফলে শিশুদের শারীরিক বিকাশ ঘটছে না। এখন ছেলে-মেয়েরা গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের এসব গ্রামীণ খেলাধুলা তো করেই না, এমনকি এসব খেলাধুলার নামও জানে না। অথচ একসময় এ সমস্ত খেলাধুলাকে বাদ দিয়ে বাঙালি ঐতিহ্যকে কল্পনাও করা যেত না। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত অচিরেই গ্রামীণ তথা দেশীয় খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। পরিণত হবে রূপকথার গল্পে।  
আধুনিক এ যুগে শিশু-কিশোররা কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ট্যাবসহ নানা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আগে শিশুরা অবসর সময় পার করত গাছের পরিচর্যা, মাঠে খেলাধুলা, হৈ-হুল্লোড় করে। কিন্তু এখনকার শিশুদের শৈশব কেড়ে নিচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। নবজাতক একটু বড় হলেই বাবা-মা তার হাতে তুলে দেন ইলেক্ট্রনিক বিভিন্ন ডিভাইস।
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক আহমাদ ফরিদ আফসোস করে বলেন, এখন আমাদের সন্তানরা বড় হচ্ছে টিভিতে কার্টুন দেখে আর কম্পিউটারে গেম খেলে। সমবয়সীদের সঙ্গে খেলার আনন্দ তারা জানেই না। মাইমশিল্পী রিফাত ইসলাম শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছেলেবেলায় আমরা বন্ধুদের নিয়ে মাঠে কত খেলাধুলাই না করেছি। কিন্তু এখনকার সময়ে সেগুলো চোখে পড়ে না। স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করা। 
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ দাউদ বলেন, মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে প্রজন্মকে রক্ষা ও গ্রামীণ খেলাকে বাঁচাতে এ দেশের সচেতন ব্যক্তিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমেই কেবল অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

×