মেট্রোরেলের সুবাদে উত্তরায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন আবাসিক ভবন
বিলম্ব হলেও জমে উঠছে উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প। মেট্রোরেল চালুর পর হঠাৎ বেড়েছে ফ্ল্যাট বিক্রি। সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তির শেষদিন গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ফ্ল্যাট। বহুল আলোচিত্ এ প্রকল্পটি আজকের অবস্থানে পৌঁছতে সময় লেগেছে প্রায় একযুগ। নি¤œ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সুবিধার্থে হাতে নেওয়া এ প্রকল্পের এখনো সাড়ে চারশ’ ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়ে গেছে।
রাজউক জানিয়েছে- সাধারণত রাজউক কোনো প্রকল্প হাতে নিলে খুব দ্রুততম সময়ে সেটা শেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে উত্তরা ১৮ নং সেক্টরের এই অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পটা বেশ বিড়ম্বনা ও জটিলতার মুখে পড়ে। এটা বাস্তবায়ন করতে একযুগ লেগে যাবে, এমনটি ছিল রাজউকের ধারণাতীত। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মাদ খান বলেন, প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কথা চিন্তা করে। যাদেরকে বলা হয় টার্গেট গ্রুপ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে- এখানে সব ফ্লাটই করা হয়েছে সাড়ে ১৬ শ’ বর্গফুটের। দামও পড়েছে অনেক বেশি যা সাধারণের ক্রয়সীমার বাইরে।
ফলে বিত্তবানরাই; যাদের ঢাকায় বাড়ি আছে, ফ্ল্যাট আছে তারাই ওখানে গিয়ে একটা/দুটো কিনে ফেলে রেখেছে। থাকার জরুরিতায় কেনেনি। এটা একটা বড় কারণ প্রকল্পটির কাজ শেষ হবার পরও সব ফ্ল্যাট বিক্রি না হওয়ার। দ্বিতীয়ত প্রতিটি ফ্ল্যাটেই বিশালাকারের গাড়ির গ্যারেজ বাধ্যতামূলক করায় খরচ বেড়েছে অস্বাভাবিক। অথচ এই প্রকল্পটি নেওয়াই হয়েছিল মেট্রোরেলের চিন্তা মাথায় নিয়ে। যাদের গাড়ি থাকবে না, শুধু মেট্রোতেই মূল শহরে যাতায়াত করবে।
সেটার ব্যত্যয় ঘটেছে। এখানে রাজউকের পরিকল্পনায় নেওয়া দরকার ছিলÑ ন্যূনতম ৭ শ’ বর্গফুট থেকে শুরু করে এক হাজার বা দেড় হাজারসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির কম দাম বা বেশি দামের ফ্ল্যাট নির্মাণ করা। তাহলেও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আগ্রহী হত্ োএবং অনেক আগেই সব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে যেত। তবে বিলম্বে হলেও এখন হয়ত ধীরে ধীরে জমবে।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত বিক্রীত ফ্ল্যাটের মধ্যে ৪ হাজার বরাদ্দগ্রহীতাকে চাবি হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই অন্যত্র বসবাস করছেন। যে কারণে প্রকল্পের পূর্ণ বসতি এখনো চোখে পড়ছে না। এখন রাজউক ও এলাকাবাসীর ধারণা, চলতি বছরের শেষের দিকে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের বাকিটুকু চালু হবার পর পাল্টে যাবে এই প্রকল্পের চিত্র।
গত রবিবার ওই এলাকা সরজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়- বিশাল জায়গাজুড়ে সারি সারি সুরম্য অট্টালিকাসদৃশ অ্যাপার্টমেন্টে মানুষজনের কোলাহল। অধিকাংশই ভাড়াটে। তাদের বেশিরভাগই গত জানুয়ারিতে আসা। দু’চার বছর এখানে থাকবেন এমন পরিকল্পনা থেকেই এখানে আসা। তারা মেট্রোতে মূল শহরে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালতের কাজ করছেন। এটা দিন দিনই বাড়ছে বলে জানিয়েছেন হারুন নামের এক ব্যবসায়ী। জানালেন- এ বছরের বাকি দশটা মাস আরেকটু কষ্ট করতে হবে। তারপর সরাসরি তিনি উত্তরা থেকে শাহবাগ নেমে বাংলা মোটরে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের সুযোগ পাবেন বেশ অনায়াসেই। যানজটে দীর্ঘ ভোগান্তির দিন একদিন শেষ হবে এমন আশায় এখন আর কিছুদিন ধৈর্য ধরে থাকবেন।
পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, প্রতিদিনই মানুষ আসছেন এখানে বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য। ফ্ল্যাট না পেলেও অন্তত মেট্রোরেলের কাছাকাছি অন্যত্রও যদি কম ভাড়ায় পাওয়া যায় তাহলে সেটাই নেবেন। মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় পরিবারসহ থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী হারুন রশীদ। তিনি জানালেন- শেওড়াপাড়ায় ১৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে। এতে তার বেতনের সিংহভাগই বাসা ভাড়া পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় কিছুটা কম টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়ার আশায় তিনি চলে আসেন উত্তরা এভিনিউ ৯ নম্বর এলাকায়। মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় বাসা নিতে চান তিনি। কেননা, সেখানে থেকেই মেট্রোরেলে চড়ে অফিস করতে চান তিনি। তবে এ এলাকায় বাসা খুঁজতে এসে আশাহত হয়েছেন তিনি। আগের মতো কম ভাড়ায় এ এলাকায় আর বাসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার অফিস কাওরানবাজারে, আর বাসা শেওড়াপাড়ায়। তবে বাসাটা পরিবর্তন করতে চাই। উত্তরায় বাসা ভাড়া কিছুটা কমে পাব, আর মেট্রোরেলে চড়ে অফিসে যাওয়া যাবে। এমন ভাবনা থেকে মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় বাসা খুঁজতে এসেছিলাম। তবে এ এলাকায় ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। ঘুরে দেখলাম, শত শত ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। ভবনগুলো নির্মাণ হয়ে গেলে আরও অনেক মানুষ এদিকে চলে আসবে। বাসা ভাড়াও বেড়ে যাবে অনেক।
অ্যাপার্টমেন্ট এলাকায়ও ভাড়া বেড়ে গেছে অনেক। মেট্রোরেল চালুর আগে ১৬ শ’ বর্গফুটের যেই ফ্ল্যাটের বাসা ভাড়া ছিল ২৫ হাজার টাকা এখন সেটার দাম উঠছে ৩০ হাজারের বেশি। প্রতিদিনই বাসা ভাড়া হচ্ছে। চাহিদা যেমন বাড়ছে ভাড়াও তেমন বাড়ছে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও উত্তরা প্রকল্পসহ আশপাশের সব এলাকায় অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল। বাসা মালিকরা ভাড়াটিয়া খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু মেট্রোরেল চালুর পর থেকেই হঠাৎ প্রচুর ভাড়াটিয়ার আনাগোানা শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই বাসা খুঁজতে মানুষ আসছে। তাই ভাড়াও আগের চেয়ে বাড়িয়েছেন বাসা মালিকরা।
এমনকি প্রকল্প সংলগ্ন আশপাশের এলাকায়ও জানুয়ারি থেকে বেড়ে গেছে ভাড়াটিয়ার আনাগোনা। বাড়িওয়ালারাও বেশ আনন্দে মেতেছে। যারা বাড়ির কাজ ফেলে রেখেছিলেন অর্ধেক তারাও দ্রুত কাজ শেষ করছেন। এমনই একজন মাসুদ বলেন- আগে এলাকা ছিল চুপচাপ। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর সেটা যেন হঠাৎ বদলে গেছে। আগে আমার বাসার তিন-চারটা ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল। এখন ফেব্রুয়ারি থেকে সেগুলো ভাড়া হয়ে গেছে। আগে এই এলাকার বাসা ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকা। এখন সেগুলো হয়েছে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা।
এদিকে ১৮ নং সেক্টরের এই প্রকল্প আগামী এক বছরের মধ্যে পুরোদমে জমে উঠবে বলে জানিয়েছেন রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের হটলাইনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামসুন্নাহার ইভা। তিনি বলেছেন- সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তির পর কত ফ্ল্যাটের আবেদন জমা পড়েছে সে হিসাব এখনো ব্যাংক থেকে আসেনি। তবে এটা বলা যায়, এখন বড় জোর আর মাত্র চারশ’ ফ্ল্যাট বাকি থাকতে পারে। আরও কিছু হয়ত থাকতে পারে যেগুলোর কিস্তি শেষ হয়নি সেজন্য চাবিও দেওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে- উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের এসব ফ্ল্যাটের প্রতিটির আয়তন ১ হাজার ৬৫০ বর্গফুটের কিছু বেশি। এখন প্রতি বর্গফুটের দাম ৪ হাজার ৮০০ টাকা। কিন্তু ২০১২ সালে উত্তরার যেসব ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয় সেগুলোর প্রতি বর্গফুটের দাম ছিল ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে। প্রায় একই আয়তনের এসব ফ্ল্যাটের মোট দাম ৫৬ লাখ টাকা। কিন্তু নতুন ফ্ল্যাটগুলোর মোট দাম পড়ছে ৭৯ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে পার্কিং ও সেবা খাতের (বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস) জন্য আরও পাঁচ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম পড়বে ৮৫ লাখ টাকা। এ কারণে এসব ফ্ল্যাট সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে বলে মনে করা হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাট যাদের ক্রমক্ষমতার মধ্যে, তারাও প্রায় ৮০ লাখ টাকাকে ‘সাদা টাকা’ হিসেবে দেখাবেন কী করে, তাও একটা বড় প্রশ্ন।
যারা এখানে ফ্ল্যাট কিনবেন তারাও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রশ্নের মুখে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। রাজউক দাবি করছে- ফ্ল্যাটের দাম বেশি মনে হতে পারে। ফ্ল্যাটের মান, উন্মুক্ত স্থান, পরিবেশসহ সুযোগ-সুবিধা চিন্তা করলে দাম বেশি নয়। রাজউকের নির্মাণ ব্যয়ও কম না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- এ প্রকল্পটি শুরুতে বেশ আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করলেও প্রকল্পের ধীরগতি ও নানা কারণে তাতে গ্রাহকদের সাড়া পড়েনি। এজন্য অন্তত ৬ দফা বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছে। বারবারই বিজ্ঞপ্তি দিয়েও গ্রাহকের সাড়া না পাওয়ায় প্রকল্পটি জমে ওঠেনি। সব ভবন নির্মিত হবার পরও জনবসতি গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ ফ্ল্যাটগ্রহীতা চাবি বুঝে নেওয়ার পরও বাস করতে আগ্রহী হননি।
এলাকাবাসী ও রাজউক সূত্র জানিয়েছে- মূলত প্রকল্পের ফ্ল্যাটের অস্বাভাবিক দাম, আগে বরাদ্দপ্রাপ্তদের ফ্ল্যাটগুলো হস্তান্তরে ধীরগতি এবং কালো টাকাকে সাদা টাকা (হোয়াইট মানি) হিসেবে দেখাতে বিড়ম্বনা থাকায় আবেদনকারীদের আগ্রহ কম ছিল এতদিন। কিন্তু মেট্রোরেল চালুর পর সব দৃশ্যপট বদলে গেছে।
এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে দিয়াবাড়ী, উত্তরা ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ নম্বর সেক্টর, সোনারগাঁও জনপথ, মেট্রোরেল চত্বর, উত্তরা মডেল টাউন, সেক্টর ১৫, এভিনিউ ৯ নম্বর, পঞ্চবটি, উত্তরা পশ্চিম এভিনিউ ও বিরলিয়া এলাকায় নতুন আবাসন প্রকল্পের কাজে ধুম লেগেছে। যেসব কাজ এতদিন ব›ধ ছিল সেগুলোতে প্রাণ ফিরেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং প্রতিষ্ঠান তৎপর হয়েছে নির্মাণ কাজে। দ্রুত সমাপ্ত হচ্ছে অসমাপ্ত কাজ।