ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

দেশের প্রথম স্মার্ট ভিলেজ ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডুর হিজলী গ্রাম

এম রায়হান, নিজস্ব সংবাদদাতা, ঝিনাইদহ 

প্রকাশিত: ১২:৩০, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩; আপডেট: ১২:৩৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দেশের প্রথম স্মার্ট ভিলেজ ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডুর হিজলী গ্রাম

জেলা প্রশাসক মনিরা বেগমকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান হিজলী গ্রমাবাসী। ছবি: জনকণ্ঠ

‘স্মার্ট ভিলেজ’। দেশের প্রথম ‘স্মার্ট ভিলেজ’ হিজলী গ্রাম। জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে গ্রামটি। ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুন্ডু উপজেলার কাপাশহাটিয়া ইউনিয়নের বাওড় পাড়ে এই হিজলী গ্রামের অবস্থান। গ্রামের প্রবেশপথে লাগানো হয়েছে সুন্দর একটি বোর্ড। 

যেখানে লেখা আছে- স্বাগতম, স্মার্ট ভিলেজ হিজলী। ৩৩৪টি পরিবার রয়েছে হিজলী গ্রামে। যেখানে ৪৯৩ জন পুরুষ ও ৫১৯ জন নারীর বসবাস। এই গ্রামের ২৩৯জন পুরুষ এবং ২৬৮ জন নারী লিখতে পড়তে পারে। যে গ্রামের মাত্র ২ জন নারী ও ২ জন পুরুষ চাকরি করে। কৃষি কাজই গ্রামের মানুষের মূল পেশা। সব মিলিয়ে  বলতে গেলে পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম হিজলী। 

হিজলী গ্রাম এখন বাল্য বিবাহমুক্ত, অপরাধমুক্ত, আত্মহত্যামুক্ত, স্বনির্ভর, ডিজিটাল এবং পরিবেশ বান্ধব। এখানে করা হয়েছে একটি স্মার্ট বৈঠকখানা। যেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে প্রতি সপ্তাহে ১দিন করে গ্রামবাসীদের সমস্যা শোনা হয় এবং তার সমাধন দেয়া হয়। 

উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে গ্রামে গড়ে উঠেছে স্মার্ট মহিলা ক্লাব। যেখানে গ্রামের নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার গল্প শুনে উৎসাহিত হয়। নির্যাতিত নারীদের প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এখন আর গ্রামে নারী নির্যাতন হয় না। যে গ্রামে বাল্যবিয়ে ছিল নিত্যদিনের। সেখানে স্মার্ট ভিলেজের কাজ শুরু হওয়ার পর একটিও বাল্যবিয়ে হয়নি। প্রশাসনের দারুণ উদ্যোগ এটি। 

হিজলী গ্রাম এক সময় ছিল সন্ত্রাসীদের আখড়া। এখানে বসবাসরত মানুষের সঙ্গে উন্নয়নের স্রোতধারার সম্পৃক্ততা ছিল না বললেই চলে। বর্তমান সরকারের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোয়ায় এই ভীতি, কুসংস্কার এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদ আলোর মুখ দেখলেও এখানকার মানুষ  অপরাধপ্রবণ, শিক্ষাগ্রহণে অনাগ্রহী এবং প্রচলিত কৃষি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থার যাপিত জীবনে অভ্যস্ত। আত্মহত্যার প্রবণতা, মাদকাসক্ত, স্মার্ট ফোনের যথেচ্ছাচার অপপ্রয়োগসহ সুদে কারবারি মরণ ফাদে পড়ে হাঁফিয়ে ওঠে এখানকার জনজীবন। সরাসরি বাস ট্রেন যোগাযোগের নেই কোন ব্যবস্থা। স্মার্ট ভিলেজ করার পর জীবন যাত্রার মান উন্নয়নসহ আমূল পরিবর্তন ঘটেছে এই হিজলী গ্রামবাসীর।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিজলী গ্রামটিকে স্মার্ট ভিলেজে বা মডেল করার উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগকে বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল তৈরি করা যা অনুসরণ করে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্টির ভাল থাকা নিশ্চিত করার কাজ চলছে। 

যার মধ্যে রয়েছে গ্রামটিতে ক্ষুদ্র কুটির হস্তশিল্পের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে গ্রামবাসীদের বিশেষ করে নারীদের দক্ষতা বাড়ানো এবং অফলাইন-অনলাইন উভয়ক্ষেত্রেই বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ করা। 

ইন্টারনেট সংযোগ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে কানেক্টিভিটি বৃদ্ধিকরণ, চাষযোগ্য জমি বিশেষ করে বাড়ির আঙিনার অনাবাদি জমিসহ শতভাগ জমিকে চাষের আওতায় এনে দেশের উৎপাদনশীলতাকে ত্বরান্বিতকরণ করা। বাল্য বিবাহ বন্ধ করার মাধ্যমে মাতৃস্বাস্থ্যের কল্যাণ এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম নিশ্চিতকরণ। 

কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা বিশেষ করে যুবক শ্রেণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। ঝড়ে পড়া, অটিষ্টিক এবং এতিম বাচ্চাসহ সব শিশুদের শিক্ষার মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা। সন্ত্রাস, নেশা এবং মোবাইল আসক্তি থেকে কিশোর কিশোরীদের দূরে রাখা। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারি অফিসসমূহকে সেবাগ্রহীতাদের দোড়গোঁড়ায় পৌঁছে দেওয়া এবং রিনিউবল শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণ করে স্মার্ট ভিলেজ ধারণা দেওয়া।

এখানকার মানুষকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের স্বাদ দিতে একটি আধুনিক এবং নিজস্বতায় সমৃদ্ধ সমাজ ও প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ স্বপ্নের সাথে এতাত্মতা প্রকাশের চিন্তা থেকেই এই হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজ করার উদ্যোগ। স্মার্ট ভিলেজ করার কারনে এই গ্রামে এখন ৩টি বাড়িতে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। 

জাইকা প্রকল্পের সহায়তায় ৫টি সোলার স্ট্রীট লাট স্থাপন, গ্রামের নামে ফেসবুজ গ্রæপ খোলা হয়েছে, গ্রামের ৭০ শতক জমিতে পারিবারিক পুষ্টির বাগান স্থাপন করা হয়েছে। যেখান থেকে নিয়মিত নিরাপদ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ২০টি বাড়িতে রান্নাঘরের আবর্জনা দিয়ে জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে। 

মৃদু প্রতিবন্ধীদের মধ্যে থেকে ৩ জনকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। গ্রামের শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য ৯ জনকে আউটসোসিং কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। স্মার্ট ভিলেজ হিজলীতে ইন্টারনেট সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। গর্ভবতী মায়েদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। গ্রামের ২০২টি টিউবওয়েল আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে। 

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে হিজলী গ্রামে স্মার্ট যুব ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে যাতে গ্রামের যুব সমাজ মোবাইল ফোনে আসক্তি কমানো যায়। মাত্র ৬ মাসের প্রচেষ্টায় দেশের প্রত্যন্ত এই হিজলী গ্রাম এখন হয়ে উঠেছে প্রথম সারির স্মার্ট ভিলেজ। গ্রামটি এখন বাল্যবিয়ে মুক্ত, মাদক ও অপরাধ মুক্ত, আত্মহত্যা মুক্ত, স্বনির্ভর ডিজিটাল ও পরিবেশবান্ধব।

হরিণাকুন্ডু উপজেলা কৃষি অফিসার হাফিজ হাসান জানান, হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজ করতে গ্রামের প্রায় ৪৫০টি উঠানের অনাবাদী জমির অর্ধেক অংশে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। অবশিষ্ট  সকল জমিও আবাদের আওতায় আসবে এবং বিষমুক্ত সবজি চাষাবাদ করা হবে। 

হরিণাকুন্ডু উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মুন্সি ফিরোজা জানান, স্মার্ট ভিলেজের সুফল ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছে। এই উদ্যেগের আওতায় ৫০টিরও বেশি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবং যে গুলোর বেশিভারই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। 

হরিনাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুস্মিতা সাহা জানান, সরকারের সব দপ্তর এক সঙ্গে হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজের মডেল করার জন্য কাজ করছে। এই মডেল কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করতে সরকারের আলাদাভাবে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে না। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের বাইরে আলাদাভাবে কোন শ্রম, বরাদ্দ বা সময়ও ব্যয় করতে হবে না। 

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জানান, প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ ধারণাকে সামনে রেখে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।  গ্রামটি সার্ভে করা হয়েছে। কোথায় কোথায় সমস্যা সব বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে সবার জন্য সেবা নিশ্চিত করা হবে এবং সরকারি অফিসের সেবা পৌঁছে যাবে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায়। এর সঙ্গে থাকবে সামাজিক মূল্যবোধ, নিজস্ব ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। 

ইতিমধ্যে হিজলী গ্রামবাসি স্মার্ট ভিলেজের উপকার পাওয়া শুরু করেছে। মাত্র ৬ মাসের প্রচেষ্টায় দেশের প্রত্যন্ত এই হিজলী গ্রাম এখন হয়ে উঠেছে প্রথম সারির স্মার্ট ভিলেজ। 

এসআর

×