ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

৯০ জনের চাকরী হলো কোন প্রকার তদবীর ছাড়া

স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট 

প্রকাশিত: ২১:২৯, ২৯ নভেম্বর ২০২২; আপডেট: ২১:৩০, ২৯ নভেম্বর ২০২২

৯০ জনের চাকরী হলো কোন প্রকার তদবীর ছাড়া

নিয়োগপত্র পেয়ে আনন্দে আত্মহারা

বৃদ্ধ বাবা বিকাশ সরদার দিনমজুর। মা শিলু বেগম প্যারালাইসিসে শর্য্যাশায়ী। থাকেন প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে। নানা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মামাদের অংশ বাদ দিয়ে নানার মুক্তিযোদ্ধার ভাতার যে এক আংশ মা পান, তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলে বন্যা সরদার এর। তবুও অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম করে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পিপুলবুনিয়া গ্রামের মেধাবী বণ্যা এমএ প্রথম পর্ব পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু নিদারুণ সংকটে আর এগুতে পারছিলেন না। তাই হণ্যে হয়ে চাকুরী খুঁজছিলেন। অবশেষে অধরা স্বপ্ন বাস্তব হল। তিনি সরকারী চাকুরী পেয়েছেন কোন তদবীর ও টাকা ছাড়াই।

মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) পরিবার কল্যান সহকারি পদে নিয়োগ পেয়ে আনন্দে কেঁদে কেঁদে বলেন, এও সত্যি! টাকা নেই-পয়সা নেই, তদবীর নেই। তারপরেও সরকারী চাকরী পেলাম। আল্লাহ দরবারে অশেষ শুকরিয়া।..’ 

আর মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ঢুলিগাতী গ্রামের ফাহমিদা মিতুর বাবা ক্ষেতমজুর। অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে জীবিকা চলে। খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে নিজে লেখাপড়া করলেও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। নিরুপায় মিতুর সংসার বাঁচাতে চাকুরী করা খুবই জরুরী হয়ে পড়ে। একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষা দিতে থাকেন। অবশেষে তিনি চাকরী পেয়ে তহবাক।

নিয়োগপত্র পেয়ে বন্যার মত মিতুও আত্মহারা আনন্দে কেঁদে ফেলেন। শুকরিয়া আদায় করেন পরম করুণাময়ের প্রতি। তাঁর ভাষায়,’ কল্পনাও করিনি আমার মত গরীব মেয়ের বিনে পয়সায়, বিনে তদবীরে চাকুরী হবে। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে।’ এসময় তার মা-বাবা এগিয়ে এসে বলেন, সব আল্লাহপাকের ইচ্ছে। মেয়েটা যে কি কষ্ট করে পড়েছে তা বলে শেষ করা যায় না। ..”

সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলার মালিয়া রাজাপুর প্রামের মনিকা রানী মাঝির বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বামী বেকার। মা বৃদ্ধ। দুই ভাইবোন মিলিয়ে ৫ জনের সংসার চলে বাবার ভাতার টাকায়। টানাটানিতে সংসার যেন আর চলছিল না। এমন সময় নিয়োগ পত্র পেয়ে মনিকাও আবেগে আত্মহারা। তার বাবার ভাষায়, আমার মেয়ের তদবির করেছেন ‘ঠাকুর ভগবান।’ তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নিয়োগ কমিটির সভাপতি বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমানের প্রতি গভীর কৃজ্ঞতা প্রকাশ করেন। 

এভাবে মোংলা উপজেলার মিঠাখাখি ইউনিয়নের চৌরিডাঙ্গা গ্রামের হাওয়া খাতুন ৬ ভাইবোন আর দিন মজুর মা-বাবাকে নিয়ে গোলপাতার ছাউনি আর পলিথিন ও সিমেন্টের খালি ব্যাগের বেড়া দেওয়া ঘরে বসবাস করেন। মেধাবী হাওয়া খাতুন অবর্ণনীয় কষ্ট সত্ত্বেও কঠিন সংগ্রাম করে লেখাপড়া করেন। কিন্তু  তীব্র অভাবের কারনে অন্য ভাইবোনদের লেখাপড়া হয়নি। তিনি চাকুরী পেয়ে যেন ‘সোনা হরিণ’ পেয়েছেন। উচ্ছসিত তার ভাষায়, আমার মত গরিব মেয়ের বিনে পয়সায়, তদবীর ছাড়াই সরকারী চাকরী হবে জীবনে ভাবিনি। আমি প্রধানমন্ত্রীসহ নিয়োগ বোর্ডের সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁদের সুস্থ দীর্ঘায়ু কামনা করি।” 

এভাবে বাগেরহাট জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে পৃথক ৪ টি পদে জেলাব্যাপী সদ্য চাকুরী পাওয়া ৯০ জনের জীবন সংগ্রাম প্রায় অনুরূপ হলেও তারা সকলেই মেধাবী। এরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তাঁর দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করেন। একইসাথে এ নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান এর প্রতি জানান কৃতজ্ঞতা। ধন্যবাদ দেন, এ নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক মো: আকিব উদ্দিন-সহ সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনকে।

অপরদিকে, চাকুরী না পাওয়া চুলকাঠি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শেখ আনিসুর রহমানের সহধর্মীনী রিনা পারভাীন বলেন, আমার কোন আক্ষেপ নেই, নিয়োগ সচ্ছ হয়েছে।’ তার স্বামী সাংবাদিক আনিসুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমার স্ত্রীর চাকুরী হয়নি, তাতে কোন ক্ষোভ নেই, কারণ যারা এই ওয়ার্ডে চাকরী হয়েছে সে অধিক মেধাবী ও গরিব।” 

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, চেষ্টা করেছি সবকিছুর উর্দ্ধে থেকে স্বচ্ছতার সাথে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করার। ভবিষ্যতেও সকল নিয়োগ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হবে বলে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জেলা প্রশাসনের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মো: হাফিজ-আল আসাদ, আরডিসি মো: রাশেদুজ্জামান এবং জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো: দিলদার হোসেন জেলা প্রশাসনের পক্ষে নিয়োগ কাজে সহায়তা করেছেন।

বাগেরহাট জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক এবং নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব মোঃ আকিব উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, জেলার নয়টি উপজেলায় দীর্ঘদিন যাবৎ পরিবার পরিকল্পনা সহকারী, পরিবার পরিকল্পপনা পরিদর্শক, পরিবার কল্যাণ সহকারী ও আয়া পদে জনবল শূণ্যতা ছিল। ফলে পরিবার পরিকল্পনা, মা, শিশু স্বাস্থ্য, স্বাভাবিক নিরাপদ প্রসব সেবাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা মারত্মক ব্যহত হচ্ছিল। জেলা পরিবার পরিকল্পনা জনবল সংক্রান্ত নিয়োগ কমিটি ৪টি ক্যাটাগরিতে জেলায় সর্বমোট ৯০ জনকে চূড়ান্ত করেন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান এঁর সার্বিক নির্দেশনায় শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এ নিয়োগ প্রদান করা হয়। এ নিয়োগের ফলে তৃণমূলে  মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবাসহ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকান্ড আরও গতিশীল হবে।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মো: হাফিজ-আল আসাদ, আরডিসি মো: রাশেদুজ্জামান এবং জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো: দিলদার হোসেন জানান, ৪টি ক্যাটাগরিতে ৯০ টি পদের বিপরীতে মোট ৫হাজার ২৫২ জন পরীক্ষার্থী আবেদন করেন। লিখিত পরীক্ষায় আয়া পদে ১৬৭ জন, পরিবার পরিকল্পনা সহকারী পদে ৯৬০ জন, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক পদে ৩৭০ জন এবং পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে ১হাজার ২২৭ অর্থাৎ মোট ২ হাজার ৭২৪ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। ডিসি স্যারের নির্দেশমত আমরা সবকিছুর উর্দ্ধে থেকে শতভাগ সচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ কজে সহায়তা করেছি। 

এমএস

সম্পর্কিত বিষয়:

×