বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, ক্ষতি কয়েক কোটি টাকার। ছবি: জনকণ্ঠ।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলার বিভিন্ন জনপদ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। উপরে পড়েছে বহু গাছপালা। ক্ষতি হয়ে পুকুরের মাছসহ জমির ফসল।
প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, সবচাইতে ক্ষতি গ্রস্থ ভোলার দুর্গম ঢাল চরের বিধ্বস্ত পরিবারগুলো এখনও চরম বিপাকে রয়েছে। অনেক পরিবারের মাথা গোজার ঠাই হারিয়ে তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। এসব পরিবারের জরুরি পুনর্বাসন প্রয়োজন।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ভোলায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলেও সরকারিভাবে এখনও এর সঠিক পরিমাণ নিরুপান করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রশাসন বলছে ক্ষতি নিরুপনের কাজ চলছে। গতকাল সোমবার রাত থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত ভোলা সদর, দৌলতখান, চরফ্যাশন ও লালমোহন উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে ও বিধ্বস্ত গাছের ঢালার সঙ্গে আঘাত পেয়ে তিনজন, পানিতে ডুবে একজন এবং ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ কাটতে গিয়ে বিদ্যুৎ স্পৃট হয়ে একজনসহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছেন। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভোলায় ঝড়ের আঘাতে দুইজন নিহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। নিহত দুই জনের দাফনের জন্য তাদের পরিবারকে ২০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার ভোর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ভোলা-বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে। তবে ইলিশা ফেরিঘাটের পল্টুন বিধ্বস্ত হওয়ায় ভোলা-লক্ষীপুর নৌরুটে বিকাল পর্যন্ত ফেরির লোড আনলোড ও চলাচল বন্ধ রয়েছে।
অপরদিকে, চরফ্যাশনের কুকরি মুকরি, মনপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বন বিভাগের কেওরা গাছের নার্সারি ও বন বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছ বলে ভোলা উপকূলীয় বন বিভাগের বন কর্মকর্তা এস এম কায়চার জানিয়েছেন।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, ঝড়ের সময় চরফ্যাশন উপজেলার হাজারিগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাজার এলাকায় মনির স্বর্ণকার (৪০) নামে এক ব্যক্তি মটর সাইকেলযোগে যাওয়ার সময় রাস্তায় ঝড়ে পড়ে থাকা গাছের ঢালার সঙ্গে আঘাত পেয়ে নিহত হয়েছেন। দৌলতখান পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ঘরের উপর গাছ পড়ে খাদিজা বেগম নামে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা এবং ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের পাকার মাথা এলাকায় বসত ঘরের উপর গাছ চাপাপড়ে মফিজুল ইসলাম (৬৫) নিহত হয়েছেন। এসম মফিজুলের ছেলে, ছেলের স্ত্রী এবং নাতি আহত হয়েছেন। ভোর রাতের দিকে লালমোহনের লডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে গেলে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় আয়শা বেগম (২৫) নামের এক নারী পানিতে ডুবে মারা যায়। আজ দুপুরে ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর এলাকায় ঝড়ে রাস্তার উপর ভেঙে পড়া গাছ কেটে সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নাছির নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন সাগর মোহনার ঢাল চর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান জানান, তার এলাকায় ঝড়ে শতাধিক ঘর বাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়াও প্রায় পাঁচশত কাঁচাপাকা ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রও বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে সব পুকুরের মাছ। সোমবার রাত থেকেই শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়। আজ দুপুরে চরফ্যাশন ইউএনও সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বিভিন্নস্থানে বিদ্যুৎ এর লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে, ঝড়ের আঘাতে উপকূলীয় এলাকায় আজ বিকাল পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। তারা জানিয়েছেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের তালিকা নিরুপণ করা হচ্ছে। জেলা কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, সোমবার রাতে ৭৪৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৭৪ হাজার ৪৮২ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এছাড়া বেড়িবাঁধ, মুজিব কিল্লা ও আশ্রয় কেন্দ্রে ২২ হাজার ৩৫১টি গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছিল।
জেলা কৃষি অফিস জানায়, প্রাথমিকভাবে ৩৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ধান, ১৫০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা মৎস্য অফিস জানায়, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলায় প্রায় ৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক ই-লাহী চৌধুরী জানান, দুর্গত মানুষের জন্য ৮৪ মেট্রিকটন চাল এবং নগদ তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই তা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের কাজ শুরু হয়েছে। আজ দুপুরে জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির উদ্যেগে সদর উপজেলার ধনীয়া ইউনিয়নের গুলি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণ তুলে দেন জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী। এসব ত্রাণের মধ্যে চিড়া, চিনি, বিস্কিট, খাবার স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানি রয়েছে।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসার খবরের পরপরই আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি মানুষের পাশে থাকতে। ঝড়ের রাতে আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ৭৪ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলো। এখন আমাদের ঝড় পরবর্তি কার্যক্রম চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী রয়েছে।
এমএইচ