কলাপাড়ায় রাতের আকাশ আলোকিত করে তারার মতো ভাসে ফানুস
প্রবারণা পূর্ণিমা রাখাইনদের ধর্মীয় বৃহৎ উৎসব। এই তিথিতে বরাবরের মতো এবছরও গত ৯ অক্টোবর রাত থেকে দুইদিন ব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করেছে কলাপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠী। অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণ ছিল আকাশে ফানুস ওড়ানোর উৎসব।
প্রতি বছর পূর্ণিমার এ তিথিতে রাতের বেলা দক্ষিণ উপকূলের কলাপাড়ায় আকাশে ভেসে বেড়ায় ফানুসের আলো। যেন তারার মেলা। আর আনন্দে মাতোয়ারা থাকে রাখাইন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর থেকে সবাই। অতিথিসহ সজনদের জন্য থাকে বিভিন্ন ধরনের পিঠে-পুলির আয়োজন। বিন্নি চালের গুড়ায় বানানো ওই পিঠে খেতে আলাদা স্বাদ, না খেলে বোঝানোর নয়। এ উৎসবে শামিল ঘটে ভিন্ন ধর্মের মানুষও। তবে এবছর অনুষ্ঠানের জৌলুস অনেক বেড়েছে। আড়াই শ’ বছরের এ উৎসবের কলেবর একটু হলেও উজ্জ্বল হয়েছে। তারপরও অনুষ্ঠানের আর্থিক যোগানে হাত বাড়াতে হয় সরকারের কাছে। এক সময়ের দাপুটে আদিবাসী রাখাইন জনগোষ্ঠী তারপরও এখন উৎসবের এ ছন্দ ধরে রাখতে পারছেন না। আর্থিক দৈন্য ছাড়াও রাখাইনরা এখন পরিণত হয়েছেন ক্ষয়িষ্ণু জাতিতে।
রাখাইনরা জানান, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসমতে গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধত্ত্ব লাভের আগে প্রায় ২৬ শ’ বছর আগে অনোমা নদীর তীরে তিনি তার চুল কেটে ফেলেন। কিন্তু এচুল মাটিতে না পড়ে স্বর্গরাজ ইন্দ্ররাজ গ্রহণ করেন এবং ‘তবতিংস স্বর্গে চুলোমনি ধাতুচৈত্তে’ হিসাবে এর পুজো করেন। পুর্ণিমার এ তিথিতে অলিক এ ঘটনা ঘটে। ধাতুচৈত্তকে শ্রদ্ধা করে প্রতিবছর প্রবারণা পুর্ণিমার তিথিতে আকাশে ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে এ উৎসব চলে আসছে। এখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা আড়াই শ’ বছর ধরে পালন করে আসছে ফানুস উৎসব।
গত রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে দুই রাতব্যাপী এই উৎসব হচ্ছে। দিনভর ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় আকাশে ফানুস ওড়ানোর উৎসব। সোমবার রাতে শেষ হয় এ অনুষ্ঠান।
মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধবিহারাধ্যক্ষ উত্তম রাখাইন জানান, তারা এ বছর রবিবার রাতে ১০০টি ফানুস আকাশে ছেড়েছেন। এজন্য তাদের প্রায় ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সর্বমোট ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
বেতকাটা পাড়ার ধর্ম বিজয় বৌদ্ধবিহার কমিটির সভাপতি মংচো জানান, রবিবার রাতে তাদের ফানুস উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে। সাধারণত চার/পাঁচ ধরনের ফানুস তৈরি করেন রাখাইনরা। যার মধ্যে রয়েছে মালা ফানুস, প্যারাসুট ফানুস, বেনসান ফানুস, লেজ ফানুস উল্লেখযোগ্য। বৌলতলী পাড়ায় রবিবার রাতে ১২টি ফানুস ওড়ানো হয়েছে। বাকিটা সোমবার রাতে ওড়ানো হয়।
কলাপাড়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহার এলাকার বাসিন্দা রাখাইন সমাজকল্যান সমিতির নেতা টেনস্যুয়ে জানান, ফানুস তৈরি করতে চাইনিজ রঙিন কাগজ, বাঁশ, সুতি
কাপড়, ছাতার জাঙ্গা, কেরোসিন, মটিয়া তেল, সুতা, মোম, গুনা এসব প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে এসব জিনিসপত্র সঠিক মানের পাওয়া যায়না। কাগজ অনেক মোটা যা আকাশে বেশি সময় ওড়েনা। নিচে পড়ে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। তারপরও কলাপাড়ার অধিকাংশ রাখাইন পাড়ায় কম হলেও ২০/৩০টি করে ফানুস প্রবারণা
পূর্ণিমার উৎসবে আকাশে ওড়ানো হয়।
প্রবীণ রাখাইনরা জানান, আসলে এসব উৎসবে এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। কারণ, অধিকাংশ রাখাইনরা গরিব। জমি-জমা অন্যায়ভাবে দখল করে নেয়া হয়েছে। এখনও দখল হচ্ছে। জালিয়াতির মাধ্যমে একটি চিহ্নিত চক্র কুয়াকাটা এলাকার মূল্যবান জমি দখল করে নিচ্ছে। এসব কারণে মানসিকভাবে উৎসবের আমেজ আর থাকেনা। তারপরও বুদ্ধের সন্তুষ্টি লাভের আশায় উৎসব করে যাচ্ছি আমরা রাখাইন সম্প্রদায়। সরকারিভাবে এ উৎসব পালনে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয় বলে তাদের দাবি।
শত দৈন্য থাকলেও প্রাবরণা পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে ফানুস উৎসবকে কেন্দ্র করে রাখাইন পল্লীতে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। নারী-পুরুষ সবাই মিলিত হয় এ উৎসবে। নতুন সাজে, নতুন পোষাকে হয় ধর্মীয় বিভিন্ন নিয়ম পালন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য জানান, এ বছর প্রবারণা পুর্ণিমা উদযাপনের লক্ষ্যে কলাপাড়ার ২৩টি রাখাইন বৌদ্ধবিহারে ৫০০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এমএইচ