করতোয়া নদীতে নৌকাডুবি
করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ইজারাদারের পাশাপাশি ওই নৌকার মাঝিকেও ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে। নিহত মাঝিকে দায়ী করায় ওই সময় ঘটনাস্থলে থাকা যাত্রীসহ স্থানীয় লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা দাবি করেছেন, শুধু কি নৌকার মাঝি ও ইজারাদারই ঘটনার জন্য দায়ী।
সেখানে উপস্থিত জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, চৌকিদার ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা কেন দায়ী নন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানই যেখানে সাক্ষ্য দিয়েছেন স্মরণকালের মর্মান্তিক নৌকাডুবির ঘটনার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং ওই নৌকায় ওঠার পর ভিড় দেখে নেমেও গেছেন। তার বক্তব্য অতিরিক্ত যাত্রী উঠায় তিনি যাত্রীদের নেমেও যেতে বলেছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেননি।
অথচ, নৌকাটিতে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠায় কয়েকজন নেমে যাওয়া যাত্রী বলেছেন ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব যাত্রী বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার জন্য কাউকেই নৌকা থেকে নেমে যেতে বলেননি উল্টো মাঝিকে নৌকাটিকে সাবধানে নিয়ে যেতে বলেছেন। বরং মাঝি নিজেই অতিরিক্ত যাত্রী নৌকায় ওঠায় বারবার নৌকা থেকে নেমে যেতে বলেছেন এবং কয়েকবার শ্যালো মেশিন বন্ধ করে দেন। যাত্রীদের চেঁচামেচিতে আবারও শ্যালো মেশিন চালিয়ে নৌকাটি ওপারে নিয়ে যেতে থাকেন। মাঝনদীতে নৌকাটি যখন দোল খাচ্ছিল তখনও মাঝি মেশিন বন্ধ করে নৌকাটিকে ফেরত আনার চেষ্টা করছিলেন। এরইমধ্যে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। ওই দুর্ঘটনায় ৭২ যাত্রীর সঙ্গে নৌকার মাঝিও মারা যান।
এদিকে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীসহ সাধারণ মানুষের মাঝে ধূ¤্র্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। গত রবিবার রাতে জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তরের বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মীদের জানানো হয়নি। পরদিন সোমবার জেলা প্রশাসক অফিস সম্মেলন কক্ষে অন্য একটি অনুষ্ঠানে গণমাধ্যম কর্মীরা তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ সময় গণমাধ্যম কর্মীরা তদন্ত প্রতিবেদনের কপি চাইলে এটা জনসমক্ষে প্রকাশ করা যাবে না বলে জেলা প্রশাসক সাফ জানিয়ে দেন। জেলা প্রশাসক বলেন, ১১৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে পুলিশ প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেগুলোও মন্ত্রী পরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।
তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ যে নির্দেশনা দেবে সে অনুযায়ী পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান। এরপরও গণমাধ্যম কর্মীরা নৌকাডুবি ঘটনার দায় কার এবং ভবিষ্যতে নৌকাডুবির ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়ে কি কি সুপারিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মর্মে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক তদন্ত প্রতিবেদনে ভয়াবহ নৌ দুর্ঘটনার জন্য খেয়াঘাটের ইজারাদারকে দায়ী করা, মাঝির অদক্ষতা ও বাধা সত্তে¡ও অতিরিক্ত যাত্রী উঠানো, মহালয়ার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য পুণ্যার্থীদের ধর্মীয় অনুভ‚তি ও অসচেতনতার অভাবসহ কয়েকটি সুপারিশের কথা উল্লেখ করেন। তবে, ওই প্রতিবেদনে শুধু ইজারাদারকে ঘিরেই নৌকাডুবির আটটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দীপঙ্কর কুমার রায় জানান, এলাকার ভৌগোলিক পরিস্থিতি এবং নদী কেন্দ্রিক জীবন জীবিকাকে উল্লেখ করে ১১৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। তদন্তে সংশ্লিষ্ট সকলের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করা হয়েছে।
বদেশ্বরী মন্দির কমিটির সভাপতি নীতিশ কুমার বকশী ওরফে মুকুল বকশী জানান, অনুষ্ঠানের আগে ইজারাদারসহ সংশ্লিষ্ট কমিটির সকলকে ৬টি নৌকা ঘাটে রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ইজারাদার তা করেননি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও বাকি নৌকাগুলো না আসায় একটিতেই হুড়োহুড়ি করে উঠে পার হওয়ার চেষ্টা করেন পুণ্যার্থীরা।
মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু আনছার রেজাউল করিম (শামীম) জানান, নৌকাডুবির ব্যাপারে জেলা পরিষদ এবং ইজারাদার দায় এড়াতে পারেন না। ঘাটের কোন উন্নয়ন হয়নি। এখানে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ বা আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ সানিউল কাদের জানান, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের হস্তান্তরিত ফেরিঘাটের ইজারা ও ব্যবস্থাপনা এবং উদ্ভ‚ত আয় বণ্টন সম্পর্কে নীতিমালা ২০০৩ অনুযায়ী জানা এসব ঘাট পরিচালনা করা হচ্ছে। নদী বন্দরগুলোর জন্য বন্দর পরিদর্শক বা ফিটনেস দেখভালের জনবল রয়েছে।
জেলা পরিষদের প্রশাসক আনোয়ার সাদাত সম্রাট জানান, বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার পূজা উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। তারা অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। তারা মাঝিকে নির্দেশ দিলে এত যাত্রী উঠত না। এত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটত না।
ওই নৌ দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর কুমার রায় এই কমিটির আহ্বায়ক।
তিনি জানান, তদন্তের পর দায় কার তা বোঝা যাবে।
এদিকে পঞ্চগড়ের নৌকাডুবির ঘটনায় এগারোতম দিনেও সীমিত আকারে উদ্ধার অভিযান চলছে। নিখোঁজ তিনজনের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বোদা উপজেলা ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন অফিসার শাহজাহান আলী জানান, অভিযানে এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নাই। মাটি এবং বালির নিচে মরদেহগুলো চাপা পড়ে যেতে পারে।
এসআর