উখেংচিং মারমা
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি নারী উখেংচিং মারমা। উখেংচিং এখন পড়ছেন বিশ্বের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)।
এই পাহাড়ি নারী এমআইটি–যাত্রার কাহিনি বলেন-
উখেংচিং মারমা বৃত্তি নিয়ে এমআইটিতে মাস্টার্স করতে গেছেন। পড়বেন কগনিটিভ সায়েন্স নিয়ে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষের মধ্যে উখেংচিংই প্রথম এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেলেন। একজন নারী হিসেবে এই অর্জন তাঁকে বেশি আপ্লুত করে বলে জানান উখেংচিং।
চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেন থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ের স্নাতক উখেংচিং। উখেংচিং বলেন, ‘আমার লক্ষ্য পাহাড়ি মানুষের জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা। এখন যে বিষয়ে মাস্টার্স করছি, তার মধ্যে ভাষাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং নৃতত্ত্বের সংমিশ্রণ আছে। আসলে জ্ঞানের প্রতিটি শাখাই একে অপরের পরিপূরক। পশ্চিমে পড়তে এসে এটা আরও বেশি করে বুঝতে পারছি।’
উখেংচিংয়ের লেখাপড়া শুরু খাগড়াছড়ির মহালছড়ির চোংড়াছড়ির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর নতুনকুঁড়ি ক্যান্টনমেন্ট হাইস্কুল থেকে এসএসসি পড়ে খাগড়াছড়ির ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মাস তিনেক পড়েছিলেন। পরে সুযোগ পান এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনে পড়ার।
বিশ্বমানের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তাঁকে আরও বিকশিত হতে সহযোগিতা করেছে বলে মনে করেন উখেংচিং। ছোটবেলায় দেখা স্বপ্নগুলো পূর্ণ করার শুরুটা এখান থেকেই।
উখেংচিং বলেন, ‘আমি যে পরিবার ও পরিবেশে যেসব সুযোগ পেয়েছি, পাহাড়ের বেশি ছেলেমেয়ে তা পায় না। পাহাড় শিক্ষায়, চিকিৎসায় এখনো অনেক পিছিয়ে। তাই চেয়েছি এসব ছেলেমেয়দের জন্য কিছু করতে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই শিক্ষকদের সহযোগিতায় উখেংচিং ও তাঁর কয়েক বন্ধু মিলে একটি প্রকল্প নিয়েছিলেন। সেই প্রকল্পের আওতায় তাঁরা ১০ জন মিলে ১০ পাহাড়ি মাধ্যমিক স্কুলপর্যায়ে পড়া ছেলেমেয়েদের বছরব্যাপী শিক্ষা সহায়তা দেন। তাঁরা পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয় পড়তে সহযোগিতা করতেন। সেই সঙ্গে তাদের কিছু অনুদানও দেওয়া হতো। এখন এসব ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
২০১৭ সালে স্নাতক শেষ করার আগেই ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিসোটায় সেন্ট ক্যাথরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের আওতায় একটি সেমিস্টারে পড়তে যান। পড়ার পর জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে চাকরি শুরু। কর্মস্থল কক্সবাজার। পেশাগত জীবনে তো লেখাপড়ার সুযোগ কমে যায়। কিন্তু হাল ছাড়েননি উখেংচিং।
২০১৯ সালের কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একটি কোর্সে ভর্তি হন। সেখানকার কোর্স এখনো চলছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। এ বিয়ে তাঁকে এক নতুন দায়িত্বও অর্পণ করে। তাঁর বিয়ে হয় খাগড়াছড়ির মং সার্কেলের সার্কেলপ্রধান বা রাজা সাচিংপ্রু চৌধুরীর সঙ্গে। পার্বত্য তিন জেলা তিনটি সার্কেলে বিভক্ত।
এর মধ্যে রাঙামাটি জেলা চাকমা সার্কেলের, বান্দরবান বোহমং সার্কেলের এবং খাগড়াছড়ি মং সার্কেলের মধ্যে পড়েছে। প্রথাগত এ প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে উখেংচিং মারমা রানি হয়ে গেলেন। এখন এই প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে এটি তাঁর কাজের প্রধান জায়গা হয়ে গেছে। এর মাধ্যমেই তিনি মানুষকে সহযোগিতা করতে চান। তিনি করছেনও।
যেমন এই করোনার মধ্যে রাজা সাচিংপ্রু সরকারি ও বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে প্রান্তিক মানুষকে সহযোগিতা করে গেছেন। ব্র্যাকের সহযোগিতা নিয়ে মেয়েদের মধ্যে ২৫ হাজার স্যানিটারি প্যাড দিয়েছেন রানি উখেংচিং মারমা। এখন এমআইটিতে পড়তে গিয়ে আনন্দের পাশাপাশি বেশি করে অনুভব করেন তাঁর প্রতি মানুষের প্রত্যাশা।
উখেংচিং বলেন, ‘আমাদের প্রথাগত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের চাওয়া অনেক। কিন্তু সেই অনুযায়ী সরকারি সহযোগিতা তো অনেক কম। মানুষ কিন্তু সেসব বোঝে না। আমি বিদেশে পড়তে এসেছি, তাদের প্রত্যাশা আমার কাছে আরও বাড়বে। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাঁদের আস্থা অগাধ। আমি সেই আস্থার মর্যাদা দিতে চাই। আমরা সবাই মিলে এই প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করতে চাই।’
এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় উখেংচিংকে অভিনন্দন জানিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজে। সেখানে তারা লিখেছে, ‘আসুন, আমরা রানি উখেংচিং মারমাকে অভিনন্দন জানাই!
তিনি বাংলাদেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম ব্যক্তি যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অবস্থিত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) স্নাতকোত্তর কার্যক্রমে ভর্তি হয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক ব্যুরোর সহায়তাপুষ্ট গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী ছিলেন।’
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেজের এই পোস্টের পর যে বিষয়টি তাঁকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হলো পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। মানুষের এসব শুভকামনা তাঁর দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলেই মনে করেন রানি উখেংচিং।
উখেংচিং মনে করেন, পাহাড়িদের সম্পর্কে এখনো অনেকের নেতিবাচক ধারণা আছে।
নারীরা সেখানে নিগ্রহের শিকার হন। বড় জনগোষ্ঠীর নেতিবাচক মনোভাবের অধিকারীদের কাছে থেকেই পাহাড়ি নারীরা চলতে-ফিরতে নিপীড়নের শিকার হন। নারীদের ওপর নিগ্রহ নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই লেখালেখি করেছেন। নিগ্রহের এসব ঘটনা বন্ধ করতে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে শিক্ষা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বোস্টনে দেড় বছরের শিশুসন্তান পেং উ প্রু চৌধুরীকে নিয়ে গেছেন। সঙ্গে আছেন উখেংচিংয়ের মা। উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—এ দুই খাতে কাজ করতে চান তিনি। পাহাড়ি মানুষের পানি ও স্যানিটেশনের কষ্ট তিনি দেখেছেন। শিক্ষার্থীদের ভাষাগত সমস্যাও তাঁর জানা। এসব বিষয়ে কাজ করার অনেক কিছু আছে বলে মনে করেন তিনি।
উখেংচিং এযাবৎ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বা ভবিষ্যতের নানা পরিকল্পনা জানাতে বারবার ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। বারবার বলছেন, ‘আমরা এ কাজ করেছি’ ‘আমরা এটা করব।’
এ ব্যাপারে মং সার্কেলের রানি বলেন, ‘আমি মনে করি সবার সম্মিলিত চেষ্টা থাকলেই বড় কিছু সম্ভব। আমার একার পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। সবাই মিলেই সুন্দরের প্রত্যাশা করতে পারি।’
পাহাড়ের জনপদ খাগড়াছড়ি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির এ যাত্রায় প্রধান উদ্দীপনা কী ছিল—জবাবে উখেংচিং বলেন, ‘সাহসে ভর করে সবকিছু করেছি। মানুষের ভালো ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য সারা জীবন কাজ করে যাব।’
টিএস