ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

চলমান ৩২ প্রকল্প থেকে আসবে ১৪৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুত

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ॥ আশার আলো দেখাচ্ছে

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ॥ আশার আলো দেখাচ্ছে

.

বিশ্বজুড়ে যখন জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা চরমে তখন দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দেখাচ্ছে আশার আলোবর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৯১০.৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুত উপাদন হচ্ছেঅগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলমান রয়েছে আরও অন্তত ৩২টি প্রকল্পের কাজএগুলো থেকে পাওয়া যাবে আরও এক হাজার ৪৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুতশুধু তাই নয় প্রক্রিয়াধীন আরও ৭৬টি প্রকল্পএইসব প্রকল্পে উপাদন হবে প্রায় ৪ হাজার ৬৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুতপাশাপাশি আমদানি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে নেপালের জলবিদ্যুতেরওএই খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভবিষ্যতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা

পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, সরকারীভাবে বিদ্যুতের উপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের কথা বলা হলেও বর্তমানে সর্বোচ্চ উপাদন হচ্ছে ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতএর বাইরে ভারতের আদানি থেকে আমদানি করা হবে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুতসম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া রামপাল থেকে জাতীয় গ্রীডে যোগ হবে আরও ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটনেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুতের পাশাপাশি জিটুজি ভিত্তিতে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের আমদানি প্রক্রিয়া চূড়ান্তএসব মাধ্যমে দেশে বিদ্যুতের সরবরাহ ছাড়াবে ২১ হাজার ৩৬৬ মেগাওয়াটের বেশিপাওয়ার সেলের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত ১৬ এপ্রিল উপাদিত হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুত

তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেছেন, দেশে বর্তমানে বিদ্যুত উপাদিত হচ্ছে ১৮ হাজার মেগাওয়াটচাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াটএই চাহিদা পূরণে ডিজেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল হতে হচ্ছেতাই নবায়নযোগ্য জ্বালানির এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উচ্চ মূল্যে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুত উপাদন করতে হবে নাচাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ থাকবে আরও বেশি

বিদ্যুত বিভাগ বলছে, জ্বালানি সঙ্কটে দেশে দেশে বিদ্যুত উপাদনে সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছেতাই নতুন করে জোর দেয়া হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতেবাংলাদেশও  বিদ্যুত উপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দেয়া হচ্ছেএরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়েছে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উপাদনের একটি চুক্তিনারায়ণগঞ্জের জালকুড়িতে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুতকেন্দ্রটি স্থাপন হলে এই কেন্দ্র থেকে ইউনিট প্রতি প্রায় ২০ টাকায় বিদ্যুত কেনা হলেও মাত্র ৫ থেকে ৬ টাকায় বিক্রি করা যাবে জানিয়ে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এই ঘাটতির সংস্থান করবে বিদ্যুত বিভাগজনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এর মূল কারণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন দেশের সব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি নির্দিষ্ট কাজ হোকতার এই আগ্রহের কারণেই এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছেশুধু তাই নয় এই কেন্দ্রটি স্থাপন হলে নারায়ণগঞ্জের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনেক ভাল অবস্থানে আসবেএই কেন্দ্র থেকে নো পেমেন্ট নো-ইলেকট্রিসিটি অনুযায়ী বিদ্যুত নেয়া হবেএখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত ২০ দশমিক ৯১ সেন্টে কিনবে পিডিবিএই চুক্তি সইয়ের পর ৪৫৫ দিনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান তিনি

শুধু বর্জ্য বিদ্যুত নয় জোর দেয়া হচ্ছে বায়ু বিদ্যুতেওমোংলায় ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকারএ জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবি গত রবিবার সন্ধ্যায় চীনের একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি সই করেছেএই চুক্তির আওতায় কনসোর্টিয়াম অব ইনভিশন এনার্জি, জিয়াংসু কোম্পানি লিমিটেড, চায়না, এসকিউ ট্রেডিং এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ ইনভিশন রিনিউয়েবল এনার্জি লিমিটেড, হংকংয়ের যৌথ উদ্যোগে এই মোংলা গ্রিন পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ করবে

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে যদিও বায়ু থেকে মাত্র ২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুত উপাদন করা হয় কিন্তু ৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উপাদনের কাজ চলমান৫টি প্রকল্পের অধীনে আরও ২৩০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুত প্রক্রিয়াধীনবায়ুভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের আকার আরও বড় হবেবিদ্যুত বিভাগ আমেরিকার ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরি প্রদত্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বলছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা বিশেষত খুলনার দাকোপ, চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং চাঁদপুরের নদী মোহনার এলাকায় ১০০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের গড়বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৬ মিটারের বেশি, যা বায়ুবিদ্যুত উপাদনে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়পিডিবি জানায়, ২০ বছর মেয়াদী এই কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত কেনা হবে ১৩ টাকায়প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬.৫৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারচুক্তি সইয়ের দুই বছরের মধ্য কেন্দ্রটি উপাদনে আসার কথা রয়েছে

বায়ুবিদ্যুতের আকার বড় করার বিষয়ে নসরুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উস হিসেবে বায়ুবিদ্যুতের আকার দিনে দিনে আরও বড় হবেউপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের ৯টি স্থানে বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশে বায়ু প্রবাহের তথ্য-উপাত্ত (ডাটা) সংগ্রহ করে ওয়াইন্ড ম্যাপিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছেসার্বিক উপযুক্ততা যাচাই করে বায়ুবিদ্যুত প্রকল্প গ্রহণ করা হবে

জোর দেয়া হচ্ছে সৌরবিদ্যুত উপাদনেওসৌরবিদ্যুত উপাদনে ইতোমধ্যে সরকারী কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছেবেসরকারী উদ্যোক্তারাও সৌর বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে দৌড়ঝাঁপ করছেবিদ্যুত বিভাগ বলছে, ভারত তাদের দেশের ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিদ্যুত উপাদনকারীদের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে

বিদ্যুত উপাদনকারী কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ বিদ্যুত উপাদন করবে তার ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উপাদন করতে হবেএই নীতিতে দেশটিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উপাদনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অগ্রসর হয়েছেযদিও বাংলাদেশে এ ধরনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু তবুও পিছিয়ে নেই সরকারপাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী দেশে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় ৩ হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত উপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে

পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সোলার পার্ক থেকে এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, সোলার রুফটপ থেকে ৬৩৫ মেগাওয়াট, সোলার হোম সিস্টেম থেকে ১০০ মেগাওয়াট, সোলার সেচ প্রকল্প থেকে ৬৩৭ মেগাওয়াট, বায়ুবিদ্যুত থেকে ৬৩৭ মেগাওয়াট, বায়োমাস বা বিশেষ করে ধানের তুষ থেকে ২৭৫ মেগাওয়াট, এনিমেল ওয়েস্ট থেকে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উপাদনের পরিকল্পনা রয়েছেআরও ৬০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুত এবং ৩ মেগাওয়াটের হাইব্রিড বিদ্যুকেন্দ্রও নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে

এসব উসের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির নতুন উস হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ব্যবহারেরও চেষ্টা করা হচ্ছেসম্প্রতি বিদ্যুত বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা করার উদ্যোগ নিয়েছেধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সঙ্কটের মধ্যে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল হতে পারে নতুন জ্বালানিবিশ্বের বিভিন্ন দেশ হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল দিয়ে বিদ্যুত উপাদনের পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেযা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশও

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্রাইটেরিয়া পূরণে আমদানি করা হচ্ছে জলবিদ্যুতওএ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, নেপাল থেকে ৫৫০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত আনবে বাংলাদেশপ্রাথমিকভাবে জিটুজি ভিত্তিতে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির বিষয়ে দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছেএই বিদ্যুত ভারত হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা দিয়ে দেশে আসবেএ জন্য দিল্লীর সঙ্গে ঢাকা ও কাঠমা-ুর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করতে হবেএ সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ও নেপাল যৌথভাবে ভারতকে অনুরোধ করতে রাজি হয়েছে বলেও জানান তিনি

সাম্প্রতি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দেয়ার প্রসঙ্গে মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের বিদ্যুত উপাদনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে আমাদের বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হবে নাএকইসঙ্গে পরিবেশেরও দূষণ হবে নাআমরা হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল নিয়ে গবেষণা করছিএছাড়া নতুন নতুন উস থেকে বিদ্যুত উপাদন করা যায় কিনা তাও দেখা হচ্ছেতিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছেযা চট্টগ্রামের কাপ্তাই-এ কর্ণফুলী নদীর ওপর দেশের প্রথম পানিবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে শুরু হয়১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে এই কেন্দ্রে ৫০ মেগাওয়াট কাপলান টাইপের টার্বাইন সংবলিত চতুর্থ এবং পঞ্চম ইউনিট স্থাপন করা হয় যাতে মোট বিদ্যুত উপাদন ২৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বেসরকারী উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করেপরবর্তীতে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) কর্তৃক সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচী ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচীএ পর্যন্ত প্রায় ৬ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকলের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচীর কারণে এর সংখ্যা বাড়ছেসাম্প্রতিক বৈশ্বিক সঙ্কটে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে বিদ্যুত বিভাগ নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে বলেও দাবি করেন তিনি

×