ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর এখন আর নেই সেই লাঠির জোরও

বিপন্নপ্রায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ‘হদি’

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বিপন্নপ্রায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ‘হদি’

এক সময় তারা ‘লাঠিয়াল’ হিসেবে রাজা-জমিদারদের ধন-সম্পদ রক্ষা করতেন। অথবা কাজ করতেন পালকির বেহারা, মালবাহক ও পাহারাদার হিসেবে। এ কারণে রাজা-জমিদারদের অতি আদর-যত্নে লালিত-পালিত হতেন তারা। কিন্তু আজ আর সেই দিন নেই। রাজা-জমিদারির প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে ‘হদি সম্প্রদায়ের’ লাঠির জোরও। বদল এসেছে পেশায়। এখন ‘হদি’ মানেই এক উপেক্ষিত, বঞ্চিত ও দারিদ্র্যপীড়িত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বলা চলে, বিপন্নপ্রায় এক জনগোষ্ঠী। সংখ্যায় নিতান্ত কম এবং বাঙালীদের সঙ্গে মিলে-মিশে বসবাসের কারণে সচরাচর কারও দৃষ্টিতে আসে না তারা। দুর্মূল্যের বাজারে বাঁশ-বেতের কাজ অথবা দিনমজুরি করে নিদারুণ কষ্টে দিন চলছে তাদের। নৃতাত্ত্বিক গবেষকরা মনে করেন- আরবী শব্দ ‘হদ’ শব্দ থেকে ‘হদি’ শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ প্রত্যন্ত বা সীমান্তবাসী। হদি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, মহাভারতে উল্লিখিত সগর রাজার কাছে পরাজিত ও নিহত হয়ে রাজার যে পঞ্চপুত্র পূর্বদিকে পালিয়ে প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যে আত্মগোপন করেছিল- তারা তাদেরই বংশধর। ওদিকে গারোদের দাবি, হদিরা আদিতে তাদের দো-আল গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবার কারও কারও মতে- এরা কোচদেরই একটি শাখা। প্রসঙ্গত, হদিদের চেহারার সঙ্গে গারো, কোচ, মান্দাই, রাজবংশীদের চেহারার মিল আছে। তারা বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আওতাভুক্ত। ২০১৬ সালের গেজেটে প্রকাশিত ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর তালিকায় হদিদের অবস্থান ৪৭ নম্বরে। অন্য আদিবাসীদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য হলো- হদিরা অন্যান্য কৌম সমাজের মতো উত্তর প্রত্যন্ত বা সীমান্তে বাস করে না। তারা সমতলের হিন্দু-মুসলমান বাঙালীদের সঙ্গে মিলে-মিশে, তবে ভিন্ন একটি সম্প্রদায়ের নামে বাস করে। সনাতন ধর্ম পালন করলেও হদিরা এখনও তথাকথিত জাত-পাতের বৈষম্যের শিকার। উচ্চবর্ণের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে আজও তারা ‘নিচু জাতের মানুষ’ হিসাবে চিহ্নিত। তবে নিম্নবর্ণের সনাতন সমাজে তারা অনেকটাই মিশে গেছে। এমনকি বিয়ে-শাদিও হচ্ছে নিম্নবর্ণের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে। এ কারণে দিন দিনই তারা হারাচ্ছে নিজস্ব স্বকীয়তা। নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা, সদর, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা, ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর, তারাকান্দা, ধোবাউড়া, গৌরীপুর, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি, নকলা ও কিশোরগঞ্জের কিছু গ্রামে হদিরা বসবাস করেন। সারা দেশে তাদের সর্বমোট জনসংখ্যা ছয়-সাত হাজারের মতো। তবে আগে তাদের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এ সম্প্রদায়ের অনেকে ভারতে পাড়ি জমান। এখনও যারা টিকে আছেন তাদের বাড়িভিটা ছাড়া জমিজমা নেই বললেই চলে। বারহাট্টা উপজেলায় সরজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ওই উপজেলার ডেমুরা, কাশতলা, সাধুহাটি, গুহিয়ালা, গড়মা ও রামভদ্রপুর গ্রামে হদি সম্প্রদায়ের মোট ১০৮টি পরিবার রয়েছে। এসব পরিবারের মোট জনসংখ্যা ৪১২। এর মধ্যে ৩৯টি পরিবার এখনও ভূমিহীন গৃহহীন। এদেরই একজন ডেমুরা গ্রামের মালতী সিং (৭৫)। নিঃসন্তান ও বিধবা মালতী কাশতলা গুচ্ছ গ্রামে মেনকা সিং নামে আরেক নারীর আশ্রয়ে থাকেন। একই অবস্থা ডেমুরার সুষমা রানী সিং (৭২) খোকন সিং (৬০) ও অনিল সিংয়েরও (৭৫)। তারাও অন্যের বাড়িতে থাকেন। কৃষি জমি আছে মাত্র তিনটি পরিবারের। ১০৮টি পরিবারের মধ্যে সরকারী চাকরি করেন মাত্র চারজন (উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিজিবির সৈনিক, আনসার সদস্য ও বিদ্যুত শ্রমিক)। এদের বেশিরভাগ বাঁশবেতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। জানা গেছে, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর হদিরা যখন লঠিয়াল, পালকির বেহারা, মালবাহক বা পাহাড়াদারের মতো পেশা হারায়Ñ তখন তারা জীবিকার টানে বাঁশবেতের কাজ করাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সেই থেকে বাঁশ-বেতের কাজই এখন তাদের জীবন-জীবিকার প্রধান উপায়। আর কিছু পুরুষ দিন মজুরির কাজ করেন অথবা রিক্সা-ভ্যান চালান। কাশতলা ও ডেমুরা গ্রামের হদি বাসিন্দারা জানান, শিশুরা ছাড়া তাদের ৮০ ভাগ মানুষই বাঁশ-বেতের কাজে পারদর্শী। বংশ পরম্পরায় বাঁশ-বেতের কাজ শেখা হয়ে যায় তাদের। সরজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতেই বাঁশ-বেতের কাজ হচ্ছে। কেউ বাঁশ কাটছেন। কেউ বেত তুলছেন। অথবা বানাচ্ছেন কুলা, ডালা, খাঁচা, ঢাকি, ডোল, ধারি, চাটি, চোকরা, পাল্লা, কাডা, খুচি, চালনি, ঠুয়া, মোড়া, পলো, পাখা প্রভৃতি গৃহস্থালী উপকরণ। ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ প্রত্যেকে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় অসাধারণ হয়ে ফুটে উঠছে একেকটি শিল্পকর্ম। দেখে মনে হয়- পুরো গ্রাম যেন এক শিল্পপল্লী। কাশতলা গ্রামের রাধা রানী ক্ষত্রিয়, জয়ন্ত ক্ষত্রিয়, দিপালী ক্ষত্রিয়সহ আরও কয়েকজন বাঁশ-বেতের কারিগর বলেন, ‘আগে বাঁশ-বেতের কাজ করে সংসার মোটামুটি চলে যেত। কিন্তু এখন আর পোষায় না। উৎপাদন খরচ বাদ দিলে খুব একটা লাভ থাকে না।’ তারা জানান, একটি বাঁশ কিনতে দুই থেকে আড়াইশ টাকা লাগে। তা কেটে বেত তুলে পরে জিনিস বানাতে হয়। একটি বাঁশ থেকে বেত তুলে জিনিস বানিয়ে শেষ করতে একজনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ লাগে। আর এক সপ্তাহে উৎপাদিত জিনিসের বিক্রয় মূল্য আসে মাত্র ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা। অর্থাৎ দিনে গড় আয় হয় মাত্র এক থেকে দেড়শ’ টাকা- যা দিয়ে এখন আর সংসার চলে না। আবার সারাবছর চাহিদা সমান থাকে না। ধানকাটার মৌসুমে বাঁশের তৈরি কিছু জিনিসের চাহিদা একটু বেশি থাকে বলে জানান পঙ্কজ ক্ষত্রিয়। বৃষ্টি ক্ষত্রিয় ও বিভা রানী ক্ষত্রিয় বলেন, ‘বাঁশ-বেতের জিনিসের চাহিদাও আগের মতো নেই। আমরা বানাই- এমন প্রতিটি জিনিসই এখন প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয়। কমদাম, সহজলভ্য এবং বেশি টেকসই হওয়ার কারণে প্লাস্টিক পণ্য ইতিমধ্যে বাজার দখল করে নিয়েছে। তাছাড়া দিন দিন বাঁশও দু®প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে দামও।’ হদিরা জানান, কুটিরশিল্পের কাজ করলেও কোন ব্যাংক বা সরকারী সংস্থা তাদের পুঁজি গঠনে এগিয়ে আসেনি। তাদের বেশিরভাগই এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণের জালে বন্দী। অসিত চন্দ্র ক্ষত্রিয় নামে একজন বলেন, ‘এই শিল্পটিতে একটি আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানো প্রয়োজন। শো-পিস তৈরির প্রশিক্ষণ দিলে হদি সম্প্রদায় বাঁশ-বেত প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে অনেক শো-পিস তৈরি করতে পারবে। বাজারে শো-পিসের চাহিদাও আছে। কিন্তু প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই।’ হদি সম্প্রদায়ের যুবক-যুবতীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও ডিজিটাল জাতিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন সহায়তায় কাশতলা গ্রামে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। ২০১৭ সাল পর্যন্ত চালু ছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কয়েকজন যুবক-যুবতী এখন বিভিন্ন জায়গায় কাজও করছেন। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ ও প্রশাসনিক সহযোগিতার অভাবে প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি তালাবন্ধ রয়েছে। নানা অভাব-অভিযোগের পরও হদি সম্প্রদায়কে ঘিরে একটি আশার দিক আছে। আর তা হচ্ছে- দেরিতে হলেও তাদের ছেলেমেয়েরা এখন লেখাপড়ার দিকে ঝুঁকেছে। হদি সম্প্রদায়ের নেতা ‘বাংলাদেশ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন’ এর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সমীরণ কুমার সিংহ জানান, বর্তমানে বারহাট্টার ছয়টি হদি গ্রামের ১১৯ জন ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে। এরমধ্যে ডিগ্রিতে পাঁচজন, উচ্চ মাধ্যমিকে ১১জন, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৬ জন ও বাদবাকিরা প্রাথমিক স্তরের। গড়মা গ্রামের অনামিকা সিংহ নামে এক কিশোরী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ছে। এখানকার হদিদের মধ্যে অনামিকাই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। কিন্তু শিক্ষার প্রতি কিছুটা ঝুঁকলেও বাল্যবিয়ের প্রবণতা এ সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব বেশি। নানা বাস্তবতায় বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে কিশোরী বয়সে। এ কারণে প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের গন্ডিতে গিয়েই শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে অনেকে। আর অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে অসুখ-বিসুখ বা পারিবারিক অশান্তিরও শিকার হচ্ছে কেউ কেউ। সমীরণ কুমার সিংহ আরও বলেন, ‘শিক্ষার প্রতি কিছুটা ঝুঁকলেও আবাসন, স্বাস্থ্য, সম্পদ, স্যানিটেশন, অধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ জনগোষ্ঠী আজও পিছিয়ে। সরকারী সহায়তা বলতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘বিশেষ এলাকার উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন সহায়তা তহবিল’ থেকে প্রতিবছর কিছু বরাদ্দ আসে। কিন্তু তার পরিমাণ খুব সামান্য। এ বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়া বাবদ। তিনি মনে করেন, হদিদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য ভূমিহীন পরিবারগুলোর মাঝে খাসজমি বন্দোবস্ত প্রয়োজন। আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করেও এ পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা সম্ভব। পাশাপাশি অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়া প্রয়োজন- যাতে হস্তশিল্প, পশুপালন, সবজি উৎপাদন, বর্গাচাষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রভৃতি আয়মূলক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। এছাড়া যারা বাঁশ-বেতের কাজ করেন- তাদেরও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক ডিজাইনের শো-পিস ও বিলাসপণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করা যেতে পারে। -সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা
×