সুবল বিশ্বাস, মাদরীপুর ॥ মাদারীপুরে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলার কবর। বছরে একদিন (২১ ফেব্রুয়ারি) কবরের আশ-পাশের ঝোঁপঝাপ একটু পরিস্কার করে শ্রদ্ধা জানায় প্রশাসন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। এরপর আর এর খোঁজ-খবর রাখে না কেউ। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ডা. গোলাম মাওলা ছিলেন একাধারে ভাষা সৈনিক, সমাজসেবক, বিশিষ্ট চিকিৎসক ও রাজনীতিক। ১৯৫২ সালে ডা. গোলাম মাওলার ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। ওই বছর ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমউদ্দিন ঘোষণা দেন “উর্দ্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এ ঘোষণার সাথে সাথে ডা. গোলাম মাওলা উত্তেজিত হয়ে বার বার বলেছিলেন ‘এর কড়া জবাব দিতে হবে’। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবায়ক এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোক্তা। অথচ, বাংলা ভাষা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভাষা সৈনিকের কবর আজ অবহেলিত।
পারিবারিক এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, ডা. গোলাম মাওলা ১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার নড়িয়া থানার পোড়াগাছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজী আব্দুল গফুর ঢালী এবং মাতা ছুটু বিবি। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ভাই গোলাম কাদের, তৃতীয় ভাই গোলাম করিম, ছোট ভাই গোলাম জিলানী এবং একমাত্র বোন রাবেয়া খাতুন। নড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও তিনি মাদারীপুর শহরে বসবাস করতেন। ডাঃ গোলাম মাওলা ১৯৪৮ সালে সিরাজগঞ্জ শহরের আব্দুল গফুর খানের বড় মেয়ে ফাতেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। তাঁর শ্বশুর ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’র ফুফাতো ভাই। বিবাহিত জীবনে তিনি এক ছেলে তিন মেয়ে’র পিতা। তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান ডাঃ গোলাম ফারুক চিকিৎসা জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
ডা. গোলাম মাওলা বর্তমান শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার পাঁচুখার কান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি নড়িয়া বিহারীলাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক, ১৯৪১ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএসসি পাস করেন। ডা. গোলাম মাওলা ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্ববিদ্যায় এমএসসি এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি মাদারীপুরে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ গঠন করা হলে ডাঃ গোলাম মাওলা ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি। কারণ ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস। তিনি ১৯৪৫-৪৬ সালে কলকাতার মুকুল ফৌজের অধিনায়কের পদ লাভ করেন। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে ২৩তম সদস্যের পদ লাভ করেন। ২ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বিপক্ষে ভোট হলে যে চারজন নেতা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ভোট দেন ডা. গোলাম মাওলা তাঁদের অন্যতম। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২’র সন্ধ্যায় আন্দোলন বেগবান করার জন্য তাঁকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহষ্পতিবার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে ১৪৪ ধারা ভাঙার সময় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার। তাদের লাশ রাখা হয় মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাকে। ডা. গোলাম মাওলা অদম্য সাহসের সাথে আহতদের দেখাশুনা ও চিকিৎসা করতেন। তিনিই প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলা ১৯৬৭ সালের ২৯ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মাদারীপুরে তাঁর নিজ বাস ভবনের সামনে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। ডা. গোলাম মাওলাকে ১৯৯৪ সালে ভাষা সৈনিক ও রাজবন্দী পরিষদ থেকে পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ডা. গোলাম মাওলাকে একুশে পদক ২০১০ (মরনোত্তর) প্রদান করা হয়। ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলার মৃত্যুর ৫৫ বছর পরও অযত্নঅবহেলায় পড়ে রয়েছে তাঁর কবরটি। সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে একদিন হয় তো হারিয়ে যাবে ইতিহাসের স্মৃতিটুকু।