ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

পায়রা সমুদ্র বন্দর গতি ফিরে পেয়েছে

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ৯ আগস্ট ২০২০

পায়রা সমুদ্র বন্দর গতি ফিরে পেয়েছে

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ॥ বাংলাদেশের অর্থনীতির তৃতীয় করিডোর খুলে গেছে। এগিয়ে চলছে অর্থনীতির চাকা। এগিয়ে চলার বাংলাদেশ, এই স্লোগান নিয়ে পায়রা বন্দর এখন দৃশ্যমানভাবে পাকাপোক্ত হয়ে দেশের অর্থনীতির যোগান দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক এ যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের পহেলা আগস্ট। ওই দিন থেকে ফরচুন বার্ড নামের (মাদার ভেসেল) নাম লিখেছে প্রথম পন্যবাহী জাহাজ হিসেবে এই বন্দরের ইতিহাসে। আর এই শুভক্ষণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তখন থেকে অর্থনীতির তৃতীয় করিডোর পায়রার দ্বার উম্মোচিত হয়। শুরু হয় পন্য আমদানি এবং খালাসের কার্যক্রম। সেই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই বন্দর থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১৬৪ কোটি ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫০১ টাকা। এছাড়া পায়রা বন্দর আয় করেছে পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার নয় টাকা। এ পর্যন্ত এ বন্দরে মোট ৭৩টি পন্যবাহী জাহাজ পন্যখালাস করেছে। ২৬ জুলাই নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জাহাজ আসার তথ্য নিশ্চিত করেছে। ইতোমধ্যে আরও দুইটি জাহাজ পণ্য খালাস সম্পন্ন করেছে। এখনও ভিড়ে আছে একটি জাহাজ। ১৪ মিটার নাব্যতার রাবনাবাদ চ্যানেলে প্রতিদিন লাইটার জাহাজ পন্য আনা-নেয়ার কাজ করছে। থাকছে প্রাণ চাঞ্চল্য। ইতোমধ্যে পায়রা বন্দর প্রকল্প এলাকায় প্রশাসনিক ভবন, সার্ভিস জেটি, পন্টুন, সিকিউরিটি ভবন, ওয়্যার হাউস, পানি শোধনাগার চালু হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসন ভবন নির্মাণ করার কাজ শেষের পথে। দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এখন বিশ্বাস করতেও অবাক লাগে এ জনপদের মানুষের কাছে। অনাবাদি থাকত, বেড়িবাঁধের বাইরের অব্যবহৃত জমি। যেখানটায় শেয়াল থাকত। দিনেও মানুষের ছিল না আনাগোনা। সেখানটায় এখন আলোকিত জনপদ। দিনরাত সমান হয়ে হয়ে গেছে। সেখানটায় দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর। পায়রা বন্দরের কাজ চলছে সমানতালে। ব্যাংক চালু হয়েছে পায়রা বন্দরে। কুয়াকাটাগামী মহাসড়ক থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত ফোরলেন সড়ক নির্মান কাজ শেষ পর্যায়ে। এখন চলছে সৌন্দর্যববর্ধন ও স্ট্রীট লাইট চালু করার কর্মকান্ড। দেশের এ তৃতীয় পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ঘিরে দক্ষিণের শেষ জনপদ পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় চলছে উন্নয়ন মহাযজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এজনপদের মানুষের ভাগ্যের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে তথা দেশের অর্থনৈতিক যোগানে এগিয়ে নিচ্ছেন পায়রাকে। এগিয়ে চলছে পায়রা বন্দরে জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ছয়টি প্রকল্পের কাজ। করোনাকালেও থেমে নেই উন্নয়ন কর্ম। ২০২৩ সালের মধ্যে পায়রার রাবনাবাদ চ্যানেলের চারিপাড়ায় নির্মাণ সম্পন্ন হবে প্রথম টার্মিনাল এবং কন্টেইনার ইয়ার্ড। প্রথম টার্মিনাল এবং কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং চীনের সিএসআইসি ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী লিমিটেডের মধ্যে ৩০ জুন চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে। ৬৫০ মিটার দীর্ঘ প্রথম টার্মিনাল নির্মিত হলে সরাসরি পণ্যবাহী মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারবে। করবে পণ্য খালাস। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৪ কোটি ৪০ লাখ ৮১ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। ৩০ মাসে কাজটি সম্পন্ন হবে। কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মিত হলে বছরে প্রায় আট লাখ ৫০ হাজার টিইউস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। এছাড়া চ্যানেলের নাব্যতা বাড়াতে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিংএর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কন্টেইনার ইয়ার্ডের কাজের আওতায় তিন লাখ ২৫ হাজার বর্গমিটার ব্যাকআপ ইয়ার্ড, প্রশাসনিক ভবন, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, ওয়ার্কশপ, ফায়ার স্টেশন, কন্টেইনার ফ্রেইড স্টেশন, গেট হাউজ, ফুয়েল স্টেশন, ভূ-গর্ভস্থ পানির আধার, পাম্প হাউস নির্মিত হবে। এ টার্মিনাল নির্মাণ পরিকল্পনা, নকশা, প্রাক্কলন এবং প্রকল্প চলাকালীন কাজ দেখাশোনার জন্য কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কুনহুয়া ডাইয়ং হেরিমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গত ১৮ জুন কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের কাজটি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটি (সিসিজিপি) অনুমোদন দিয়েছে। ঠিকাদার বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে বন্দর সূত্রে জানা গেছে। করোনাকালেও থেমে নেই দেশের এই মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন কর্মকান্ড। সকল ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এগিয়ে চলছে উন্নয়ন কাজ। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৗশল ও উন্নয়ন) কমডোর এম জাকিরুল ইসলাম জনকন্ঠকে জানান, পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ এবং এ সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে পায়রা বন্দরের পুরো কার্যক্রম চালু হয়ে যাবে। এ ছাড়া রাবনাবাদ চ্যানেলের পাড়ে লালুয়া ইউনিয়নের চারিপাড়ায় প্রথম টার্মিনাল এলাকায় যাতায়াতের জন্য ছয় লেনের সড়ক নির্মাণের উদ্যাগ নেয়া হয়েছে। এ সড়কের আন্ধারমানিক নদীর ইটবাড়িয়া-চিংগুড়িয়া পয়েন্টে আরও একটি সেতু নির্মাণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘চট্রগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার জট লেগে থাকে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হন। আনুষঙ্গিক সকল সুবিধাসহ পায়রা বন্দরকে পুরোপুরি চালু করা গেলে দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা পায়রা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এর ফলে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের যেমন উন্নতি হবে, তেমনি দেশও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। পায়রাকে ঘিরে দেশের অর্থনীতিতে নতুন করিডোর হওয়ায় সম্ভাবনার দূয়ার খুলে গেল। এই এলাকার সাধারণ মানুষসহ লগ্নিকারকরা পায়রাকে ঘিরে ব্যবসার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত করছেন। উল্লেখ্য ২০১৩ সালের ১৯ নবেম্বর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার রামনাবাদ মোহনায় আন্ধার মানিক নদীর তীরে টিয়াখালীতে ১৬ একর জমির ওপর দেশের তৃতীয় ‘পায়রা সমুদ্র বন্দর’ প্রকল্প কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আর থামেনি উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। এখন দেশের তথা বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি পায়রা বন্দরের দিকে।
×