ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

বগুড়া নগরীর ইতিহাস নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছে একটি বটবৃক্ষ

প্রকাশিত: ২০:০৪, ৪ জুলাই ২০২০

বগুড়া নগরীর ইতিহাস নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছে একটি বটবৃক্ষ

সমুদ্র হক ॥ বট গাছ বা বট বৃক্ষ। এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। আজও পরিবারের জীবিত বয়স্ক ব্যক্তিকে বট বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বট গাছের শাখা প্রশাখা যেমন চারধারে বিস্তৃত করে পরিবেশ রক্ষা করে দাবদাহ থেকে মুক্ত করে ছায়া দেয় তেমনই প্রবীণ ব্যক্তি পরিবারের সকল সদস্যকে আগলে রাখে ছায়াতলে। দিনে দিনে কাঠুরিয়ার কুড়ালের কোপ পড়ছে বটের ওপর। এতকিছুর মধ্যেও বগুড়া জেলা প্রশাসন অফিসের ভেতরে একটি বট বৃক্ষ কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। যা বগুড়া নগরীর প্রাচীন ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। প্রবীণরা বলেন, একটা সময় বগুড়া নগরীর চার ধারে ছিল বট পাকুরের গাছ। স্টেশন রোডের দুই ধারে ছিল কয়েকটি বট গাছ। নবাববাড়ী সড়কের ধারে ছিল পাকুর গাছ। শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় টেম্পল রোডের প্রবেশের মুখেই ছিল বট গাছ। গোহাইল রোডে পুরাতন পশু চিকিৎসালয়ের সামনে, ফুলবাড়িতে বগুড়া-রংপুর রোডের দুই ধারে দুইটি বট গাছ, মালতিনগর, চকলোকমানসহ প্রায় প্রতিটি এলাকায় ছিল বট গাছ। এই বট গাছগুলো আজ আর নেই। নগরীতে বহুতল ভবনের নির্মাণযজ্ঞ, সড়ক চওড়াকরণ ও নগরীর সম্প্রসারণে প্রথম কুড়ালের কোপ পড়ে বট গাছের ওপর। কেউ এই বৃক্ষকে রাখেনি। বগুড়ার সাবেক জেলা প্রশাসক হুমায়ূন কবির এই বট বৃক্ষের চারধারে টাইলসে বেঁধে সৌন্দর্যবর্ধন করেছিলেন। বাঁধানো স্থানে মঞ্চের মতো করে অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। জাতীয় দিবস, বর্ষবরণ, বাউল উৎসব, ঋতুভিত্তিক উৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো বটের তলে প্রাকৃতিক পরিবেশে। মঞ্চের সামনে শতরঞ্জি বিছিয়ে ও পেছনে প্লাস্টিকের চেয়ারে দর্শক শ্রোতাদের বসবার ব্যবস্থা করা হতো। সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বট গাছকে এমনভাবে আলোকসজ্জা করা হতো মনে হতো আকাশের তারা নেমে এসেছে। এখন আর কোন আয়োজন নেই। শুধু বটবৃক্ষটিই আছে। নিত্যদিন যারা জেলা প্রশাসন অফিসে নানা কাজে আসেন তারা ক্লান্ত হলে বটের ছায়ায় কিছুক্ষণ বসে প্রাণ জুড়িয়ে নেয়। গ্রীষ্মে শহরের অনেকেই এই বটের ছায়ার কিছুক্ষণ বসে থাকে। বাতাস উঠলে মনে হবে প্রকৃতি ধরনী শীতল করে দিল বটের শাখা দুলিয়ে। দূর অতীতে বগুড়ার অন্যতম পরিচিতি ছিল বট বৃক্ষের শহর। গ্রীষ্মের দাবদাহ শহরের মানুষকে কাবু করতে পারত না। দিনে রাতে পাড়া মহল্লায় রাস্তার ধারের বটের ছায়ায় লোকজন বসত। বটবৃক্ষ বগুড়াকে প্রকৃতির কোলে রেখে প্রগতির ধারাকে এগিয়ে নিয়েছে। প্রবীণরা তাদের পূর্বসূরীদের কাছে থেকে জেনে বলেন, বগুড়ার কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় ছিল মাটির চওড়া রাস্তা। মধ্যে ছিল বট গাছ। বিভিন্ন স্থান থেকে গরু ও মহিষের গাড়িতে লোকজন এসে কাজ সেরে ফিরে যেত। বগুড়ার অনেক পাড়ার বাড়ির লোকেশন চিহ্নিত করা হতো বটতলা দিয়ে। বটতলার সেই শহর আজ অতীত। জেলা প্রশাসন চত্বরের বটবৃক্ষটি মনে করিয়ে দেয় অতীত স্মৃতি। একটা সময় গ্রামেও ছিল অনেক বট গাছ। খেয়া ঘাটে বট গাছ থাকত। বট তলা ছিল মানুষের মিলন কেন্দ্র। খেয়া ঘাটে বট গাছের নিচে বাঁশের মাচাং থাকত। লোকজন সেখানে বসে কিছুটা সময় জুড়িয়ে নিত। মেলাও বসতো বটের নিচে। বট গাছ নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘লুটিয়ে পড়ে জটিল জটা, ঘন পাতায় গহন ঘটা, হেথা-হোথায় রবির ছটা-পুকুর ধারে বট।’ জীবনানন্দ দাশ বটের ছায়ায় বিজন ঘাসে শুয়ে প্রকৃতিকে কাছে পেয়েছেন। ভাওয়াইয়া গানের কথায় ‘বট বৃক্ষের ছায়া যেমন রে মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে...’। দেশাত্মবোধক গানেও এসেছে বট ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা অঘ্রাণে নবান্নের উৎসবে...’। পরিবেশবিদগণ গবেষণা করে দেখেছেন, যখন কোন প্রজাতি ধ্বংস হয়ে পরিবেশের ইকো সিস্টেম নষ্ট করে তখন ধরে নেয়া যায় সেই জায়গা থেকে বট গাছ নিধন হয়েছে। পরিবেশবিদ ড. হোসেন শাহরিয়ার বলেন, বড় বট গাছকে জীব বৈচিত্র্যের আবাসিক হোটেল বলা হয়। একটি বট গাছকে ঘিরে পাখিসহ অন্তত ৩শ’ ৫০ প্রজাতির কীটপতঙ্গ জীব বাস করে। বাদুর, চিল এরা বসে বট গাছে। চিলের বড় আবাস বট গাছ। বট গাছ কমে যাওয়ায় চিলের আবাসও ভেঙ্গে পড়েছে। ড. শাহরিয়ার জানান, একটি বট গাছ কাটার সঙ্গে ৩শ’ ৫০ প্রজাতির আবাস নষ্ট হয়। এরা আশ্রয়ের সন্ধানে ঘোরে। কোথাও আশ্রয় না মিললে এক সময় হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ ভাবে জীব বৈচিত্রের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বট গাছ রোপিত হয় না। বট গাছ ছড়িয়ে পড়ে পাখির মাধ্যমে। যেমন চিল বট গাছের ফল খেয়ে বর্জ্যরে মাধ্যমে বীজ ফেলে দেয়। সেখানেই গজিয়ে ওঠে বট গাছ। চিল উড়তে পারে অনেকটা সময় ধরে। এই সময়ে কোন চিল বটের ফল খেয়ে বহু দূরে গিয়ে বিষ্ঠা ফেললে সেখানেই গজিয়ে ওঠে বট গাছ। তবে বট গাছের নিচে যে বীজ পরে তা নষ্ট হয় সালোকসংশ্লেশনের (ফটোসেনথিসিস) অভাবে। বিশাল বট বৃক্ষের ডালপালা থেকে নেমে আসা ঝুরি বা শাখা মূলে দোলনা বানিয়ে দোল খাওয়া হতো। কবিগুরুর কবিতায়- ‘শতেক শাখা বাহু তুলি, বায়ুর সাথে কোলাকুলি, আনন্দতে দোলাদুলি, গভীর প্রেম ভরে’। বটের বৈজ্ঞানিক নাম ফিকাস বেঙ্গালিনসিস। এর নিকটতম জাত ফিকাস কমোসা। এই জাতকে বলা হয় পাকুড়। বট পাকুড় দেখতে কাছাকাছি পাতা ও ঝুরির পার্থক্য ছাড়া। এই বট পাকুড় রক্ষায় তেমন উদ্যোগ নেই। হালে বনসাই বট আছে কারও ড্রইং রুমে। বছর কয়েক আগে সরকারীভাবে বলা হয়েছিল পুরানো বট গাছ রক্ষা করা হবে। তা ওই পর্যন্তই। বর্ষায় বৃক্ষ রোপণ মৌসুমে বন বিভাগের কাছেও বট চারা মেলে না। প্রদর্শনীতে বটের বনসাই (বামুন গাছ) দেখে বলতে হয় একদা বিশাল বট বৃক্ষ ছিল।
×