নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর ॥ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর এক নারীকে তার সন্তানরা টাঙ্গাইলের সখীপুরের জঙ্গলে ফেলে রেখে গেছে এমন একটি খবর গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লেও অনুসন্ধানে মিলেছে ভিন্ন তথ্য। মূলতঃ সাজেদা বেগম ওরফে পাগলী (৪৮) নামে ওই নারী শেরপুরের নালিতাবাড়ীর নয়, তিনি পার্শ্ববর্তী শ্রীবরদী উপজেলার ভেলুয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত ঢনঢনিয়া গ্রামের অধিবাসী। তিনি স্থানীয় সাহমত আলীর স্ত্রী ও ৩ সন্তানের জননী। তিনি দীর্ঘদিন যাবত মানসিক ভারসাম্যহীন ও গত ২৪ দিন আগে থেকে নিখোঁজ ছিলেন। তাকে তার সন্তানরা সেখানে ফেলে রেখে আসেননি, বরং নিখোঁজের পর থেকেই হন্যে হয়ে তাকে খুঁজছেন সন্তানরা। এলাকায় এলাকায় করা হয়েছে মাইকিং ও ছবিসহ পোস্টারিং।
জানা যায়, সোমবার রাত দেড়টার দিকে টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার একটি শাল-গজারির বন থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন। পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করা হয়। পরে তার শরীরে সর্দি-কাশি ও জ্বরসহ করোনার উপসর্গ থাকায় রাতেই তাকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় পাঠানো হলেও পরীক্ষায় তার করোনা নেগেটিভ আসে। আর সেই নারীকে উদ্ধারের খবরে বলা হয়, তার বাড়ি নালিতাবাড়ী উপজেলায়, তাকে তার সন্তানেরা করোনার ভয়ে জঙ্গলে ফেলে গেছেন। খবরটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়লে আস্তে আস্তে তার স্বজনদের কানে পৌঁছায়। বুধবার বিকেলে জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে মেলে সঠিক তথ্য। আর তা হচ্ছে, দরিদ্র পরিবারের ওই নারী দীর্ঘদিন যাবত মানসিক ভারসাম্যহীন। তার ৩ সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছানোয়ার হোসেন ও বড় মেয়ে সাহানা বেগম ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করে সেখানে বসবাস করলেও ছোট মেয়ে শাবানা সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের বিবাহসূত্রে গৃহিণী। গত ২১ মার্চ থেকে তিনি ছোট মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে নিজ বাড়ি থেকে বের হলেও সেখানে আর পৌঁছেননি।
বরং সেদিন থেকেই নিখোঁজ হন তিনি। এরপর স্বামী-সন্তানসহ আত্মীয়-স্বজনরা বিভিন্ন এলাকায় খুঁজাখুঁজি করে তাকে না পেয়ে এলাকায় এলাকায় করেন মাইকিং। সেইসাথে ওই নারীর ছবিসহ করেন ব্যাপক পোস্টারিং। সেইসাথে একমাত্র ছেলে ছানোয়ার হোসেন ফেসবুকেও ছবিসহ ছড়ান মায়ের নিখোঁজের খবর। কিন্তু এরপরও তার সন্ধান না পেয়ে স্বামী-সন্তানসহ আত্মীয়-স্বজনরা যখন হতাশ অবস্থায় সময় পার করছেন, ঠিক তখনই নিখোঁজের দীর্ঘ ২৪ দিনের মাথায় পাওয়া যায় ভিন্ন তথ্যে জঙ্গল থেকে তাকে উদ্ধারের খবর।
ঘটনার বিষয়ে ওই নারীর ছেলে ছানোয়ার হোসেন দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, নিখোঁজের পর থানায় জিডি না হলেও এলাকায় এলাকায় মাইকিং ও ছবিসহ ব্যাপক পোস্টারিং করা হয়েছে। সন্ধান চেয়ে দেওয়া হয়েছে ফেসবুক পোস্ট। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে তিনি ও তার এক বোন পোশাক তৈরির কারখানা মাঝপথে বন্ধ হলেও ঢাকাতেও অবস্থান করছেন। ওই নারীর ছোট মেয়ে শাবানা বেগম, ভগ্নিপতি শেরপুর শহরের উত্তরা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি আব্দুল লতিফ ও ও আত্মীয় তোতা মিয়াও একই তথ্য দিয়ে বলেন, উদ্ধারের খবরেই তাকে চিকিৎসকের মতামতে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা হয়েছে। সেইসাথে তারা প্রমাণ হিসেবে হারানোর সময়কালে করা ছবিসহ পোস্টারিং ও ফেসবুকে দেওয়া পোস্টের নমুনা প্রদর্শন করেন। কাজেই তাকে সন্তানরা জঙ্গলে ফেলে রেখে আসার তথ্যটি সঠিক নয়। বরং তা অতিরঞ্জিত ও আবেগী তথ্য।
বিষয়টি সম্পর্কে ভেলুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মিঞা মোঃ মিজানুর রহমান জানান, ওই মহিলার পরিবারটি পূর্বে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার নাপিতেরচর গ্রামের অধিবাসী হলেও ১৪/১৫ বছর যাবত ঢনঢনিয়া এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনি প্রকৃতই একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী। প্রায় এক মাস আগে তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর এলাকায় এলাকায় মাইকিং ও তার ছবিসহ পোস্টারিং হয়েছে। এরপরও তার পরিবারের লোকজন তাকে খুঁজেই যাচ্ছিলেন। কাজেই তাকে সন্তানরা জঙ্গলে ফেলে আসবে- এমনটা বিশ্বাসের কারণ দেখি না।
এ ব্যাপারে শ্রীবরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন তালুকদার দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, সখীপুরের জঙ্গলে উদ্ধার হওয়া ওই নারী শ্রীবরদীর অধিবাসী হওয়ায় আমরাও তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছি। আমাদের প্রাপ্ত তথ্যমতে, সে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা এবং প্রায় ১ মাস যাবত নিখোঁজ ছিল। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই নিখোঁজের বিষয়ে থানায় কোন সাধারণ ডায়েরী হয়নি। তবে এলাকায় মাইকিং, ছবিসহ পোস্টারিং ও ফেসবুকে সন্ধান চেয়ে পোস্ট দেওয়ার সত্যতা রয়েছে।