বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ ॥ এক সময় উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষা এই নওগাঁ মহকুমা ছিল গাঁজার জন্য বিখ্যাত। এশিয়া উপ-মহাদেশে এই নওগাঁকে ‘গাঁজার নওগাঁ’ বলেই চিনত সকলে। কালের বিবর্তনে আজ সেই নওগাঁ জেলাতে রূপান্তরিত হয়েছে। বিখ্যাত হয়ে উঠেছে ধান-চালের দিকে। এখন উত্তরের আবাদ উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে নওগাঁকে সকলেই চেনে। কিন্তু নওগাঁর সেই গাঁজা চাষ ও রক্ষণাবেক্ষণের স্মৃতি চিহ্ন আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নওগাঁয় উৎকৃষ্ট মানের গাঁজা উৎপাদনের কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার শহরের পুরনো হাসপাতাল এবং এসডিও অফিসের (বর্তমানে ডিসির বাংলো) মাঝখানে ছোট যমুনা নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে প্রায় ৫ একর জমির ওপর গড়ে তুলেছিল এই গাঁজা কমপ্লেক্স। চারদিকে প্রাচীর বেষ্টিত গাঁজা কমপ্লেক্সের ভেতরে রয়েছে ৬টি ছোট-বড় গুদাম। যার ১টিতে রয়েছে গাঁজা। এছাড়াও রয়েছে অফিস ভবন, ব্যারাক, ক্রাশারভবন, বাসভবনসহ আরও কয়েকটি ভবন। প্রাচীরের পূর্বপাশে নদীর তীরে রয়েছে গাঁজা পোড়ানো চুল্লি। অন্য সম্পদের মধ্যে জেলা সদরে অবস্থিত বিশাল গাঁজা কমপ্লেক্সে (গাঁজা গোলায়) ৪ হাজার মণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৬ বৃহদাকার গুদাম দীর্ঘ ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে অব্যবহৃত রয়েছে। বর্তমানে গাঁজা গোলা চত্বরটি পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে। পার্শ্ববর্তী দোকানিরা অভিযোগ করে বলেন, ওই গাঁজা গোলা চত্বরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সুপারিন্টেন্ডের অফিস রয়েছে। এর পরেও বিশাল ওই নির্জন কমপ্লেক্সের আনাচে-কানাছে বসে নেশাখোরদের আড্ডা। ইতোমধ্যেই গুদাম ঘরের বারান্দার মূল্যবান অনেক লোহার খুঁটি চুরি হয়ে গেছে। গুদামের বারান্দার এক পাশে তৈরি করা হয়েছে একটি গোয়াল ঘর। এসব পাহারা দেয়ার মতোও কোন লোক নিয়োগ নেই। স্থানীয় লোকজন সেই চত্বরে এখন গরু চড়ায়। জানা গেছে, বিগত ১৯৮৮ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার নওগাঁসহ সারাদেশে গাঁজা উৎপাদন ও বিক্রি সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সে বছরের উৎপাদিত ২৬০ মণ গাঁজা গুদামে সিলগালা করে রাখা হয়। এর আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এদিকে স্থানীয় গাঁজা সোসাইটি এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মধ্যে অর্থের দেনা পাওনা নিয়ে রয়েছে মতবিরোধ। এনিয়ে মামলাও করা হয়েছিল। সোসাইটি দাবি করছে, তারা ওই গাঁজার মূল্য বাবদ সরকারের কাছে ৩৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা পাবে। এ টাকা তারা গাঁজা উৎপাদনের সময় চাষীদের আগাম দিয়েছিল। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, সোসাইটির কাছে উল্টো সরকারের পাওনা রয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা। যে গুদামে গাঁজা রয়েছে, তাতে আদালত থেকে সিলগালা করা হয়েছে। সূত্র মতে, গাঁজা পাহারার কাজে নিয়োজিত কর্মচারী ও মনুষ্য ব্যবহারে অনুপযোগী গাঁজা পোড়ানোর খরচ সোসাইটি দিচ্ছে না। এতে সরকারের কাছে তাদের দেনার পরিমাণ বাড়ছেই।
অন্যদিকে ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে গুদামে রক্ষিত গাঁজা পাউডার হয়েছে নাকি মাটিতে মিশে গেছে, নাকি ইঁদুরে খেয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। কবে নাগাদ গুদামের সিলগালা খোলা হবে নাকি আদৌ খোলা হবে না, তা কেউ বলতে পারছে না। এই কমপ্লেক্সের ভেতরেই রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সুপারিন্টেন্ডের অফিস। স্বল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে তারা জেলার ১১ উপজেলাতে মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। তাদের অনুপস্থিতিতে গোটা চত্বরটিতে বিরাজ করে ভুতুরে অবস্থা। এ বিষয়ে ওই অফিসের সুপার জানান, তাদের অফিসে কর্মরত কোন ব্যক্তি এই চত্বরে গরু-ছাগল প্রতিপালন করে না। তবে খোলা ও নিরিবিলি পরিবেশে স্থানীয় কিছু লোকজনের গরু-ছাগল চত্বরের ঘাস খেয়ে থাকে। ওই চত্বরে কেউ মাদক সেবন করে, এমন কথা তার জানা নেই। তবে এমন যদি কেউ দেখেন, তাহলে তাদের ধরতে সহায়তা চেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন, পরিত্যক্ত ওই বিশাল গুদামগুলোকে কৃষি গুদামে পরিণত করলে একদিকে যেমন সরকার লাভবান হতো অন্যদিকে ওই চত্বরের উন্নয়ন হলে শহরেরও পরিবেশ দৃষ্টিনন্দন হতো।