জাতীয় ঐকমত্য ধরে রাখতে গণতন্ত্রমনা সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সংলাপ জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হামলার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটিকে পুঁজি করে অনেকে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে । শনিবার দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গণফোরামের সপ্তম জাতীয় সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন একথা বলেন। ড. কামাল হোসেনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান দলটির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। কাউন্সিল উদ্বোধন করেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিহত ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়ার বাবা শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া।
সকালে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়। কাউন্সিল উদ্বোধন করেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিহত ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়ার বাবা শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া। এর পর জাতীয় পতাকা, দলীয় পতাকা উত্তোলন করে শান্তির প্রতীক পায়রা ওড়ানো হয়। গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, বিপ্লবী গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি সাইফুল হক, গণফোরাম নেতা মোস্তফা হোসেন মন্টু। সম্মেলন উদ্বোধন করেন শহিদুল ইসলাম ভূইয়া।
ড.কামাল হোসেন বলেন, বিগত ১৬ বছর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নির্লজ্জ দলীয়করণের ফলে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। এই সব প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে সহযোগিতা করা সব রাজনৈতিক দল ও দেশের জনগণের নৈতিক দায়িত্ব। যাতে সংস্কার সুষ্ঠুভাবে করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে যে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে তা ধরে রাখা প্রয়োজন। এজন্য গণতন্ত্রমনা সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সংলাপ জরুরি বলে আমি মনে করি।
গণফোরাম নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে ড. কামাল হোসেন বলেন, আজকের কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে ঐক্যকে আরও সুসংহত করবেন। সেই ঐক্যের মধ্য দিয়েই যা কিছু অর্জন আমরা করতে পারি। এই ঐক্য না হওয়াটাই অতীতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এবার যে ঐক্য গড়ে উঠেছে সেটাকে সুসংহত করে ঘোষিত লক্ষ্যগুলো আমরা যেন অর্জন করতে পারি। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে গণফোরাম ইমেরিটাস সভাপতি বলেন, দেশের জনগণ স্বপ্ন দেখেছেন এক স্বাধীন ও নতুন বাংলাদেশের। এই অর্জন সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। আমি আশা করি গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারসহ বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে নেতাকর্মীরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, গণফোরাম জন্মলগ্নে বিরাজমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। তা ৩১ বছর পর আরও তীব্র সংকট রূপে আবির্ভূত হয়েছে। গণতন্ত্রহীনতা ও স্বৈরাচারের কবলে পড়ে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ অবাধে লুটপাট, দুর্নীতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে দেশ শাসনের ফলে সর্বত্র ভয়াবহ সংকট ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। এর ফলশ্রুতিতে ছাত্র-জনতার এক অবিস্মরণীয় গণজাগরণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন , আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা নেই, সেটা আমি কিন্তু বলব না। এটা ব্যতিক্রম, এটাকে যেভাবে দেখিয়ে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সেটা তো বাংলাদেশ নয়। কলকাতায় বাংলাদেশের দূতাবাস ভাঙছে, বিভিন্ন দেশে যে প্রতিক্রিয়া হয়- এই অস্থিরতা বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু অস্থির করছে না, সেই প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। অন্যরা যেটা করছে, সেটা বাংলাদেশে করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সাবধান থাকতে হবে- সতর্ক থাকতে হবে; এর মাধ্যমে আগামী বাংলদেশ গড়ার যে স্বপ্ন সেটা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, শান্তিপূর্র্ণভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেন আমরা ফিরে যেতে পারি।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আপনারা দেখেছেন, বিভিন্ন ঘটনাবলী যেটা ১৫-১৬ বছরে ছিল না, এখন দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিভিন্ন সংস্থা নামছে, একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে, এসব দাবি-দাওয়ার পেছনে অন্য শক্তি কাজ করছে, কারা এটা Ñ আমাদের বুঝতে হবে। এই শক্তির উৎস কোথায় তা জানতে হবে। ইদানীং যে ঘটনাগুলো ঘটছে ধর্মের নামে, আসলে কি ধর্মের নামে যে দাবি-দাওয়াগুলো, সেগুলো বোঝার জন্য আরেকটু গভীরভাবে দেখতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, সংস্কার নিয়ে কারও চিন্তা করার দরকার নেই, সংস্কার আমরা করব। আমীর খসরু বলেন, স্বৈরাচারের দোসররা কিন্তু বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বিভিন্নভাবে শুরু করেছে। কখনো আনসারের বিদ্রোহ, কখনো সংখ্যালঘু, কখনো অটোরিক্সার মাধ্যমে, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। স্বৈরাচারকে সরিয়েছি, আজকে কিন্তু আমাদের ঐক্যকে অটুট রাখতে হবে। জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে একটা কারণে; মানুষের প্রত্যাশা, আকাক্সক্ষা পূরণ করতে হলে আপনাকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যেতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, যুদ্ধটা ছিল গণতন্ত্রের জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধটা হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। আমরা সম্মিলিতভাবে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যেতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি এবং আমরা সেটা করতে চাই এই কারণে- এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আগামী দিনে যেন একটা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে পারি; এটা আমাদের লক্ষ্য। সংস্কারের কথা যারা বলে, তার বহু আগে ৩১ দফা সংস্কারের কথা এক বছর আগে তুলে ধরেছি। সেই ৩১ দফার মধ্যে আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সবকিছু আছে। সেটা আমরা করব। আগামীদিনে নির্বাচনের পরে যে সরকার হবে, সেটা হবে জাতীয় সরকার এবং সেই জাতীয় সরকার এই ৩১ দফা সংস্কার বাস্তবায়ন করবে। এটা আমরা জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
গণফেরামের জাতীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেন, দেশ ও জাতি আজ কঠিন সময় পার করেছে। একটি দুষ্ট চক্র দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে চায়। ভারত সরকারও ওই দুষ্ট চক্রকে উস্কানি দিচ্ছে। বর্তমান ভারত সরকার সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে চলছে। ভারতের এই সরকারই সে দেশের গান্ধীকে হত্যা করেছিল। তিনি বলেন, চিন্ময়কে কেন্দ্র করে ভারত বাংলাদেশের পতাকা পুড়িয়েছে। বাংলাদেশের দূতাবাসে হামলা করেছে।