স্টাফ রিপোর্টার ॥ জলবায়ু পরিবর্তন আর পানির অতি ব্যবহার কিংবা কখনও অপব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এক সময় যখন পাতালের পানি শেষ হয়ে যাবে তখন পানির বিকল্প ব্যবস্থা কি হবে? বিশুদ্ধ খাবার পানির প্রচণ্ড অভাব কিভাবে সামাল দেব আমরা? এখনও বাংলাদেশের বহু জায়গায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংস্থান নেই । আয়রন, আর্সেনিকসহ অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ প্রচুর পরিমাণে পানিতে মিশে আছে; ক্ষেত্র বিশেষে যা কিনা মরণঘাতী রূপ নিতে পারে।এইতো বছর কয়েক আগেও কুষ্টিয়া এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় আর্সেনিক দূষণ ছিল মারাত্মক আকারে। পান করলেই শুরু হত নানা বিধ স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সমস্যা। এখনও আয়রন এবং আর্সেনিক এর জন্য ডিপ টিউবওয়েল এর পানি ঠিকমত খাওয়া যায় না।
২০১২ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২৫০জনে রমত। ২০১৩ তে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০০জন।এর অন্যতম কারণ হল সরকার থেকে এর আগে আর্সেনিক মুক্ত গভীর নলকূপ দেয়া হলেও ভূগর্ভের পানিস্তর বদলে যাওয়ায় সেসব গভীর নলকূপেও এখন আর্সেনিক পাওয়া যায় ।আমরা কি এই সময়ের জন্য তৈরি ?
১৯৯৩ সাল থেকে হিসাব করলে দেখা যায় যে বর্তমানে আর্সেনিকের প্রকোপ মোটামুটি অর্ধেকে নেমে এসেছে।এই হারে আর্সেনিক দূর হতে আরও ১৮ বছর লাগবে। পানি বাহিত এসব রোগ প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি জনগণকে রক্ষা করার জন্য টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সহযাত্রী হিসেবে এগিয়ে এসেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। সামাজিক দায়বদ্ধতার মূলনীতিকে মাথায় রেখে, এবং এসডিজি-র ৬ নং অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে গৃহীত এই সম্প্রদায়-ভিত্তিক প্রকল্পের নাম 'প্রবাহ' | সরকারের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সঙ্গে কাধ মিলিয়ে ২০০৯ সাল থেকে ‘প্রবাহ’প্রকল্পটি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়পানি শোধনাগার প্লান্ট বসিয়ে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের কাজ করে চলেছে | কুষ্টিয়া সুগারমিলস এর সামনেই আমরা দেখতে পাই বেশ বড়সড় প্রবাহ-রবিশুদ্ধ খাবার পানির প্রকল্প । এর সামনে দাড়িয়েই কথা হল নবাব আলীর সঙ্গে। তিনি থাকেন কুষ্টিয়ার মিনা পাড়াতে। সেখান থেকেই পাঁচ মিনিট বাইক চালিয়ে প্রতিদিন তিনবার করে পানি সংগ্রহ করতে আসেন। ছেলেরা নাতি নাতনিসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০জন।যত খাবার পানি লাগে সব প্রবাহ প্রকল্প থেকে তিনিই নিয়ে নেন।
বীণা রানী মন্ডল থাকেন আরও কাছে। ছয় সাত মিনিট হেটেই চলে আসেন প্রবাহের প্লান্টের কাছে। ভরা কলস নিয়ে যখন ফিরছিলেন তখন কথা হল তার সঙ্গে। বীণা রানী জানালেন, ‘বড় মেয়েটার বিয়ে হচ্ছিলনা মেলা দিন ধরে। কারণ হাত ভরা আর্সেনিক এর দাগ। প্রবাহ আসার পর থেকে নিয়মিত এই জল খাই। মেয়ের হাতের রোগ তো সারলোই, ছোট মেয়েটারও কোন দিন এ ধরণের রোগ হয়নি | দুজনকেই বিয়ে-শাদি দিয়ে দিয়েছি। ঘরে এখন সুখের সময়।’
সিরাজুল ইসলাম মন্ডলের হাতেও চর্মরোগ হয়েছিল। কুষ্টিয়া শহর থেকে একটু দূরে আহমেদপুরে থাকেন ৮৫ বছরের এই বৃদ্ধ। জানালেন, ‘একসময় চর্মরোগ হয়ে খুবই বিপদে ছিলাম। মাঠে কাজ করতে পারতাম না | কাজ না করলে তো আর আয় হয়না; তার উপর আবার ওষুধের খরচ | পরে সরকার থেকে ডিপটিউবয়েল দিয়েছিল, এর পর ভাল ছিলাম কিছু দিন। ২০১১ সালে বাড়ির সামনে প্রবাহ এর প্লান্টবসে, তখন থেকে ইনিয়মিত প্রবাহের পানি ব্যবহার করছি। যৌবনে যে চর্মরোগ বিষিয়ে তুলেছিল জীবনটা, ৮৫ বছরে এসে এখন তার ছিটেফোঁটা ও আমার নেই’ । এখন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছেন সিরাজুল ইসলাম মন্ডল।
সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষে –এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিএটিবি পানি পরিশোধনের এই উদ্যোগ গ্রহণ করে ২০০৯ সালে। এই মুহূর্তে ৮৭টি প্রবাহ প্লান্ট থেকে প্রতিদিন সাড়ে চার লাখ লিটার বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ হয় । এতে সরাসরি উপকৃত হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। যারা আর্সেনিক আয়রনসহ বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ এত দিন খাবার পানির সঙ্গে খেয়ে আসছেন। প্রবাহ আসার পর তাদের সেই সমস্যা কেটেছে।
এই পানি শোধনের প্লান্টগুলো টেকসই উপায়ে পরিচালিত হচ্ছে এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক দু'জায়গাতেই গভীর অবদান রাখছে। ২০০৯ সালে প্রবাহের যাত্রা শুরু করার সময় বেছে নেয় বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত সিডকোলিমিটেড -এর জার্মান প্রযুক্তির পানি পরিশোধন ব্যবস্থা। কয়েক স্তরের পরিশোধনে এইপ্লান্ট আর্সেনিক, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাসসহ অনেক বিষাক্ত দ্রব্য থেকে পানিকে মুক্ত করে।
ব্যবহারকারীদের কাছে এটা শুধুই একটি বিশুদ্ধ খাবার পানির প্লান্ট নয়, প্রবাহ তাদের কাছে পরিবারের অংশ। আগেরমত আর চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আর আক্রান্ত হচ্ছেন না প্রবাহর সুবিধা ভোগীরা। খরচ হচ্ছে না চিকিৎসার পেছনে বাড়তি টাকা। পানকরা এবং রান্নার জন্য সহজেই তারা হাতের কাছে পাচ্ছেন বিষমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি। বেঁচে যাচ্ছে টাকাও সময়, আর ঠিক থাকছে শরীর। আর এজন্যই এই উদ্ভাবনী টেকসই প্রকল্পটি অর্জন করেছে এশিয়ারে স্পন্সিবল এন্টারপ্রেনারশিপ আওয়ার্ড ২০১৫ | এছাড়াও,বাংলাদেশ ব্র্যান্ডফোরাম থেকে মোস্ট ইনোভেটিভ এসডিজি ইনক্লিউশন অ্যাওয়ার্ড ২০১৮ ।
জাতিসংঘের টেকসইউন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টাকে বলিষ্ঠ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ 'প্রবাহ' প্রকল্পের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের জন্য নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থা করে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের যেসব জায়গায় পানির সংকট আছে, সেখানে প্রকল্পটির বিস্তৃতি করার লক্ষ্যে দৃঢ় প্রত্যয়ী | বিশুদ্ধ খাবার পানির সমস্যা নিরসনে সরকারের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানি থেকে শুরু করে বেসরকারী সংস্থা, এনজিও এবং অন্যান্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে |