স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ করোনা মোকাবেলায় সারাদেশ লক ডাউনের পর পরই টানা দশদিনের ছুটি পেয়ে নদী ও সড়ক পথে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ছুঁটে এসেছেন কয়েক লাখ মানুষ। এরপূর্বে প্রবাস থেকে কয়েক হাজার মানুষ এসেছেন। দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম লক ডাউন হওয়া শরিয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার অসংখ্য মানুষ আত্মীয়তার সুবাধে সুস্থ্য ও অসুস্থ্য অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছেন বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। ফলে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলা।
সূত্রমতে, ইতোমধ্যে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই রোগীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত এক ব্যক্তির গ্রামের বাড়ি লকডাউন করে মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত হতে শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। অপর দুইজনকে স্বাভাবিক নিয়মেই দাফন করা হলেও তাদের স্ব-স্ব গ্রামবাসীর মধ্যে করোনা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বর্তমানে জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলেও চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীরা। এছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অদ্যবর্ধি করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ মেশিন পিসিআর ও কিটস এসে পৌঁছায়নি। ফলে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মধ্যে ক্রমেই করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পরেছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য বরিশাল বিভাগে ৭৮২টি আইসোলেশন বেডের ব্যবস্থা করা হলেও আইসিইউ প্রস্তুত রয়েছে মাত্র দুইটি। শেবাচিম হাসপাতালে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত করোনা সন্দেহে ছয়জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ভর্তি হওয়া আরো দুইজন সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ বাকির হোসেন জানান, ২০টি আইসোলেশন বেড ও দুইটি আইসিইউ প্রস্তুত রয়েছে। প্রয়োজনে ১৫০টি আইসোলেশন বেড ও আরও আটটি আইসিইউ প্রস্তুত করা যাবে। তিনি আরও জানান, হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য এক হাজার পিস ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম পিপিইসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বন্টন করে দেয়া হয়েছে। তবে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ মেশিন পিসিআর ও কিট এখনও এসে পৌঁছায়নি।
এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় দুই সহ¯্রাধিক রোগী চিকিৎসাধীন থাকলেও করোনা আতঙ্কে কমেছে রোগীর সংখ্যা। বর্তমানে হাসপাতালে ৫৩৯ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, করোনা আতঙ্কে বিভিন্নরোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা সেবা নিতে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগীদের অভিযোগ চিকিৎসকেরা হাসপাতালে আসছেন না। বরিশালের বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে জানা গেছে, হঠাৎ করেই চিকিৎসকরা রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে সাধারণ চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
অপরদিকে গত ১০ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনসহ বিভাগের ছয় জেলায় মোট হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ২ হাজার ৭৫৮ জনের মধ্যে ১ হাজার ২০৪ জনকে কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ শেষে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থানের পর কোনো উপসর্গ দেখা না যাওয়ায় উল্লেখিতদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডাঃ শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, করোনা সন্দেহে হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডগুলোতে রোগী ভর্তি করা হলেও এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস সংক্রমিত কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। তিনি আরও বলেন, বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৮২টি আইসোলেশন বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরমধ্যে শেবাচিম হাসপাতালে দুইটি আইসিইউ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
করোনা সন্দেহে মৃত রোগীদের ব্যাপারে খোঁজনিয়ে জানা গেছে, বরিশালের মুলাদী উপজেলায় গ্রামীন ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার বকুলবাড়িয়া ইউনিয়নের পশ্চিম পাতাবুনিয়া গ্রামের মৃত মাওলানা আব্দুল মোতালেব হাওলাদারের পুত্র জাকির হোসেন (৪০) দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ্য ছিলেন। তিনি পটুয়াখালী সদরের বহালগাছিয়া এলাকার শ্বশুরবাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। সেখান থেকে সর্দি জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে শনিবার তাকে শেবাচিম হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি করার পর রবিবার সকালে তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে আইইডিসিআরের নির্দেশনা অনুযায়ি তাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করার পর বাড়িটি লকডাউন করা হয়েছে। দাফন ও জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। একইসাথে মৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।
অপরদিকে শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তির পর করোনা ইউনিটে নেয়ার সাথে সাথে বরিশাল নগরীর কাউনিয়া পুরানপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোঃ দুলালের স্ত্রী দুই সন্তানের জননী নিরু বেগমের (৪৫) মৃত্যু হয়েছে। মৃত রোগীর স্বজনরা জানান, নিরু বেগম ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনদিন আগে বরিশাল সদর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে চিকিৎসায় সুস্থ্য হয়ে তিনি বাড়িতে ফিরে যান। এরপর বাড়িতে বসে তিনি জ্বর, গলাব্যাথা ও শ্বাসকস্টে আক্রান্ত হন। শনিবার তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাত পৌঁনে ১২টার দিকে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিরু বেগমের ডায়বেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ ছিলো।
এছাড়া রবিবার সকালে জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যাথা ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে গৌরনদী সরিকল ইউনিয়নের সাকোকাঠী গ্রামের বেলায়েত হোসেন খানের স্ত্রী আলেয়া বেগম (৬০) মারা গেছেন। ফলে গ্রামবাসীর মধ্যে করোনা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, অতিসম্প্রতি তাদের গ্রামে মাদারীপুর ও শরিয়তপুর থেকে একাধিক ব্যক্তি এসে অবস্থান করার পর থেকেই তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত জাহান বলেন, আলেয়া বেগমের মৃত্যুর বিষয়টি এলাকাবাসী তাকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানানোর পর তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের অবহিত করেছেন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা খোঁজ খবর নিয়ে তাকে জানিয়েছেন, আলেয়া বেগমের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তিনি (ইউএনও) গ্রামবাসীকে আতঙ্কিত না হয়ে সর্তকতার সাথে সরকারের নির্দেশ মানার জন্য আহবান করেন।
বরিশাল বিভাগের পর্যটন শিল্প, পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে কাজ করতে আসা বিদেশী নাগরিক, প্রবাসীসহ নানা কারণে করোনার প্রকোপ দেখা দেয়ার আশঙ্কায় করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য শেবাচিম হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে ল্যাব স্থাপনের দাবি জানিয়ে বরিশালের চৌকস জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত হাসপাতাল হচ্ছে শেবাচিম হাসপাতাল। জরুরি ভিত্তিত্বে এখানে যেন করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণের ল্যাব স্থাপন করা হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন মহলে আবেদন করা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের সার্বিক জনসংখ্যা, বিদেশ ফেরত এবং হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার চিত্র তুলে ধরে এই আবেদন করা হয়েছে।
সূত্রমতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বরিশালে সার্বিক সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনার অংশহিসেবে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতন করার কাজটি স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে স্থানীয় প্রশাসন একযোগে করে যাচ্ছে। তবে সরকারি হিসেবে যে পরিমাণ প্রবাসী বরিশাল বিভাগে এসেছেন তার থেকে অনেক কম প্রবাসীকে হোম কোয়ারেন্টিনে নেয়া সম্ভব হয়েছে। যে কারণে বিভাগের ছয় জেলার মানুষের মাঝে এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, বরিশাল জেলা সদর সবচেয়ে বেশি জনবহুল ও লোকসমাগম সম্পন্ন এলাকা। বিভাগের বাকী পাঁচ জেলা ও মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ফরিদপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলার লোকজনও বিভিন্ন কাজে বিভাগীয় শহর বরিশালে আসেন। এরমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহত চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতেই আসেন বেশি মানুষ। সেক্ষেত্রে এ হাসপাতালকে ঘিরে জরুরি ভিত্তিত্বে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ল্যাব স্থাপনের দাবি গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর।